সংবিধান, গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে সে নির্বাচন by ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় দশম সংসদীয় নির্বাচন। কিন্তু সেটা কোন ধরনের নির্বাচন, যেখানে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছেন? অর্থাৎ বাকি আসনগুলোতে কোনো নির্বাচন না হলে বা না করলেও ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার অনায়াসে আবার সরকার গঠন করে ক্ষমতায় থাকতে পারত। এই তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের বেশির ভাগ ভোটারের প্রাথমিক মৌলিক, সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ধরনের নির্বাচন পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাকি ১৪৭টি আসনের নির্বাচনের দিন ভোটার উপস্থিতি এতই কম ছিল যে, তা যেকোনো সঠিক, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির শতকরা হারের সাথে কোনো তুলনায়ই আসবে না।
ভোটারদের শতকরা উপস্থিতির ব্যাপারে আলোচনার দরকারই বা কী; যেখানে একজন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে একাই ৫০০টি ভোট দিয়েছেন? ৪০টিরও অধিক সেন্টারে কোনো একটি ভোটও পড়েনি! অসংখ্য সেন্টারে ভোটারদের কোনো লাইন দেখা যায়নি। পুলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারেরা অলসভাবে বসে বা ঘুমিয়ে দিন কাটিয়েছেন। আবার অনেক সেন্টারে তারা নিজে দায়িত্ব নিয়ে টেবিল কাস্টিংয়ের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন। ১৪৭ জন এমপি নির্বাচিত করতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ১৮০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসকের আমলে আশির দশকে ভোটারহীন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার জাতিকে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন নামক এক নতুন সংস্কৃতি উপহার দিলো। সত্যিকার অর্থে ওই নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটও পড়েনি। জালভোটসহ হিসাব করলেও কোনোমতেই শতকরা ১০ ভাগের ওপর ভোট পড়েনি বলে অনেক নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী মনে করেন।
জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনই গণতন্ত্রের মূল কথা। কার্যকর অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিদের সঠিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভোটারদের বিকল্প পছন্দের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে এবং ভোটারেরা যাতে তাদের রায় তাদের একান্ত খুশিমতো প্রয়োগ করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার সংসদ থেকে গঠিত হয় এবং সংসদের কাছেই সরকারের জবাবদিহি করতে হয়। সংসদ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে, সেই দলের নেতা বা নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হন। গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচন কি সত্যিকার অর্থে কোনো নির্বাচন ছিল? ওই নির্বাচনে জনগণের সঠিক অর্থে কি আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল? সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা আছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র... এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংসদ এবং এই সংসদ থেকে গঠিত মন্ত্রিসভা নিঃসন্দেহে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণের কোনো কার্যকর অংশগ্রহণ ছিল না।
অপর দিকে, বাংলাদেশের সংবিধান নিজেই স্পষ্ট করে বলেছে, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা বা আসনের জন্য সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তাই সরকারের বৈধতাদানকারী ক্ষমতার উৎস যারা, সেসব ভোটারকে  বঞ্চিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি বা আসন বরাদ্দের প্রশ্ন বা প্রথা সংসদীয় গণতন্ত্রে আসতেই পারে না। সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হইবে।’ গত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের আলোকে প্রত্যেকটি একক নির্বাচনী এলাকা হতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হননি। তা ছাড়া নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে মিডিয়াতে বলেছেন, ‘যদি বিএনপি নির্বাচনে আসত আমরা তাদের সাথেও আসন ভাগাভাগি করতাম, যেভাবে আমরা জাতীয় পার্টি এবং জোটের অন্য দলগুলোর সাথে করেছি।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা শুধু অগণতান্ত্রিক ও সংসদীয় গণতন্ত্রের নীতিবিরোধীই নয়; বরং বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি হলো একটি কালো দিবস। ইতিহাসের পরিক্রমায় অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞাটি সবচেয়ে বেশি বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তিনি গণতন্ত্রকে বলেছেন, ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার।’ আব্রাহাম লিংকনের সেই ঐতিহাসিক সংজ্ঞার মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে। সত্যিকার গণতন্ত্রে জনগণের আশা, আকাক্সা ও প্রত্যাশাই হলো বড় কথা। বর্তমান সরকার জনগণের সরকার মোটেই নয়। কারণ ম্যান্ডেট দেয়ার  দিনে অর্থাৎ নির্বাচনের দিন জনগণ প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় অবাধে ও নির্বিঘেœ অংশগ্রহণ করতে পারেনি বা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। অপর দিকে, বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা গঠিত বা নির্বাচিত নয়। কারণ জনগণকে তাদের মৌলিক সাংবিধানিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর যদি কোনো সরকার জনগণের বা জনগণের দ্বারা না হয়, তাহলে আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞানুসারে জনগণের জন্যও হবে না। তাই বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা অনুযায়ী, বর্তমান বাংলাদেশের সরকার মোটেই গণতান্ত্রিক নয়।
ফ্রি এবং ফেয়ার নির্বাচন গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি ছাড়া অন্যটি চিন্তাই করা যায় না। এ ব্যাপারে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে Indian case [(2002) 8 SCC 237]: বলেছে ÔFree fair ... elections are part of the basic structure of the Constitution…. Democracy and free and fair elections are inseparable twins. There is almost an in severable umbilical cord joining them. The little man’s ballot and not the bullet is the heart beat of democracy.Õ
বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের অন্যতম সদস্য। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতিসঙ্ঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বহু আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও চুক্তির স্বাক্ষরদানকারী দেশ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দলিল হলো ÔThe Universal Declaration of Human Rights (UDHR) Ges International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR). UDHR এর ২১(৩) অনুচ্ছেদে-এ স্পষ্ট করে বলা আছে ÔThe will of the people shall be the basis of the authority of government; this will shall be expressed in periodic and genuine elections which shall be by universal and equal suffrage and shall be held by secret vote or by equivalent free voting procedures.Õ অপর দিকে, ICCPR এর ২৫(বি) অনুচ্ছেদে আছে ÔEvery citizen shall have the right and the opportunity to vote and to be elected at genuine periodic elections which shall be by universal and equal suffrage and shall be held by secret ballot, guaranteeing the free expression of the will of the electors.Õস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে উপরোল্লিখিত দু’টি দলিলের অনুচ্ছেদগুলো পালন ও রিকোয়ারমেন্টগুলো মানা বাংলাদেশের জন্য আবশ্যক। গত বছর ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচন UDHR এর ২১(৩) অনুচ্ছেদ ও ICCPR এর ২৫(বি) অনুচ্ছেদেও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ ওই নির্বাচিনটি সত্যিকার অর্থে কোনো নির্বাচন ছিল না এবং ভোটারেরা তাদের ম্যান্ডেট অবাধে ও মুক্তভাবে প্রকাশ করার সুযোগই পায়নি। তাই বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ব বা বৈধতার ভিত্তি জনগণের ইচ্ছা বা রায় নয়। কারণ পঞ্চাশ শতাংশের ওপর ভোটারদের ভোটের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, সংবিধান, গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইনের চোখে গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সত্যিকার অর্থে কেনো নির্বাচন নয়। তাই বর্তমান সরকারের দেশ চালানোর কোনো বৈধতা নেই। সরকার বৈধ হবে কিভাবে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়েছে অথবা তাদের ভোটের ব্যাপারে মুক্ত পছন্দের কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। সাধারণ বিবেক, নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের প্রাথমিক নীতি ও আচারের দাবিই হলো যে, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ম্যান্ডেট ও সাপোর্ট নিয়েই গঠিত হবে। বর্তমান সরকার কি এই ম্যান্ডেটটি সঠিকভাবে নিয়েছে? তাই তো দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট নিশা দেসাই ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির শুনানিতে স্পষ্ট করে বলেছেন-ÔOn January 5, the government held a deeply flawed election in which one of the two major political parties did not participate. As a result, over half of the 300 members of Parliament were elected unopposed, and most of the rest faced only token opposition. The election did not credibly express the will of the Bangladeshi people. This could have serious ramifications for stability in Bangladesh and the region.Õ
নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্টেটমেন্ট ইস্যু করেছে, যাতে বলা হয়েছে, ÔThe election was not a credible reflection of the will of the people and called for immediate dialogue to agree on new election as soon as possible.Õ  ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যখনই সরকার জানে যে তারা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নয় তখন তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। দেশ চালানোর জন্য এ ধরনের সরকারের মূল সম্বল হয় শক্তির ব্যবহার, গলাবাজি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, একগুঁয়েমি এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ। এই উপসর্গগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। একটি সত্যিকার অবাধ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিতামুলক সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেশের বর্তমান অবস্থার কোনো উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। বরং বর্তমান সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকবে। তার সাথে সাথে সরকার আস্তে আস্তে নির্যাতনকারী এক ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারীর রুদ্রমূর্তি নিয়ে আবির্ভূূত হবে। যত তাড়াতাড়ি দেশের মানুষ, সুশীলসমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে, হবে দেশের জনগণের জন্য মঙ্গল।
লেখক : ব্রিটেন প্রবাসী আইনজীবী ও বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.