রোকেয়া by রঞ্জন কর্মকার

৯ ডিসেম্বর নারী অন্দোলনের এক বিশেষ দিন। কারণ এ দিনেই জন্মেছিলেন নারী জাগরণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, মারাও গিয়েছিলেন একই দিনে।
রোকেয়ার কাছে নারীমুক্তি ও নারী প্রগতি আন্দোলনের হাতিয়ার ছিল প্রধানত তিনটি। প্রথমত : প্রয়াত স্বামীর নামাংকিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল; দ্বিতীয়ত : সমাজসেবী নারী সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম বা নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি এবং তৃতীয়ত : তার ক্ষুরধার লেখনী। অর্থাৎ তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন আন্দোলন হিসেবেই; আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন আন্দোলন হিসেবেই এবং প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্প, লিখেছেন, অর্থাৎ সাহিত্যচর্চা তথা সাহিত্য সাধনা করেছেন আন্দোলনের লক্ষ্যেই। এ ছাড়া ভোটাধিকার অর্জনের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কাজ করেছেন, অন্যতম প্রতিনিধি রূপে ইংরেজ সরকারের কাছে বা মন্টেগু-চেমসফোর্ড কমিটির কাছে নারীর ভোটাধিকার দাবি পেশ করেছেন- আন্দোলনের লক্ষ্যেই। এ আন্দোলন হচ্ছে নারীর সমকক্ষতা, সমতা, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার বিষয়ে সমাজে নারী-পুরুষ সবাইকে সচেতন ও সংগঠিত করা।
রোকেয়ার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যেসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, সমাজের সার্বিক উন্নতির স্বার্থে সে সম্পর্কে কাজও করেছেন। রোকেয়া প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল স্বদেশের স্বাধীনতা। আর তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সবার আগে দরকার নারী স্বাধীনতা। তাই তিনি নারী স্বাধীনতার জন্য নিরলস কাজ করেছেন।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিতে নারীর সমঅধিকার ও অবস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০১৩ অনুযায়ী সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে ছিল অষ্টম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ এ বিষয়ে আরও কিছুটা এগিয়েছে।
তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়েছে। রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণের বিধি চালু হওয়া সত্ত্বেও কোনো দলে এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দলীয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি মোটেই উল্লেখ করার মতো নয়। নারী উন্নয়ন নীতিমালায়, এমনকি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় সংসদের ১০০টি আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের কথা থাকলেও সেটা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ কোনো সরকার এখন পর্যন্ত নেয়নি।
ব্যাপক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংঘর্ষ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি-২০১৩ সালে পুরো দেশকে যেভাবে আতংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তা নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথকে যথেষ্ট সংকুচিত করে ফেলেছে। এর ফল হিসেবে ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ৫৪০ প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মাত্র ২৭ নারী (৫%)। মন্ত্রিসভায়ও নারীর উপস্থিতি কমে গেছে।
প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এবং নারীর প্রতি নেতিবাচক মন-মানসিকতার কারণে উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, উচ্চ বেতনে চাকরিসহ জীবন বিকাশের বিভিন্ন সুযোগ থেকে নারী প্রায়ই বঞ্চিত হয়। এ সুযোগগুলো পেলে হয়তো অনেক নারীই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন অবস্থানে পৌঁছে যেতে পারতেন। এ বঞ্চনা নারীর মুক্ত চলাচল ও স্বাভাবিক অগ্রগতির পথও বন্ধ করে দেয়।
আট দশকের বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়ার মৃত্যু হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়েও তার মহিমা এতটুকু ক্ষুণ্ন না হয়ে বরং তা দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। আজ যারা আমাদের দেশে নারীমুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন, যারা নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জোরদার করার চেষ্টা করছেন, তারা প্রতি মুহূর্তেই রোকেয়ার মতো কালজয়ী প্রতিভার কথা স্মরণ করবেন, তার রচনাবলী পাঠ করে সাহস ও শক্তি সংগ্রহ করবেন এবং তার জীবন সংগ্রাম থেকে প্রেরণা লাভ করবেন- এটাই প্রত্যাশা।
রঞ্জন কর্মকার : একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.