জানুয়ারিতে ডিসিসি নির্বাচন

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রথমদিকে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় সব ধরনের প্রস্তুতির পরও এ নির্বাচন হয়নি। পরে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচন ঝুলে আছে। তবে সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। নতুন বছরের শুরুতে বিভক্ত ডিসিসি নির্বাচন আয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরনো জেলা ময়মনসিংহকে আলাদা বিভাগ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিভাগ করার আগেই ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম চালু করা হবে বলেও জানান তিনি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ও বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এতে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১৪-এর খসড়া উত্থাপন করা হলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের আপত্তির মুখে তা ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। আইনটিতে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসকদের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করার প্রস্তাব ছিল।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের পর আলোচনায় এলে প্রথমেই এর বিরোধিতা করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সঙ্গে সঙ্গে তাকে সমর্থন জানান, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এরপর প্রায় সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী প্রস্তাবিত আইনটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রশাসকদের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছর করা হলে ডিসিসির বিষয়ে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাই এটি সংশোধন না করে আগে যা ছিল তাই রাখা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুমন্ত্রীর এ বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, প্রশাসকের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলে জনগণ তা ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডিসিসির নির্বাচন দিতে হবে। সরকারও নির্বাচন দিতে চায় বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মানুষ যাকে ভোট দেবে সেই জিতবে। ফলাফল যাই হোক নির্বাচন দিতে হবে। এ সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বিভক্ত করার ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি জানান, ৭০ লাখ জনসংখ্যার লন্ডন শহরে মিউনিসিপালিটি রয়েছে ৬টি। আমাদের রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি জনসংখ্যায় ডিসিসিকে আরও কয়েকটি অংশে বিভক্ত করা প্রয়োজন। কারণ এত জনসংখ্যার চাপে ডিসিসি সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ডিসিসির নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার তাগাদা দেন। এ সময় আশরাফ তার সম্মতি জানান। তিনি বলেন, ডিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তার মন্ত্রণালয় প্রস্তুত। তবে প্রস্তাবিত এ আইনটি একটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য করা হয়েছে। তার মতে, মেয়রের অনুপস্থিতিতে সিটি কর্পোরেশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতেই প্রশাসক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন করা হয়েছে।
২০০২ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বর্জন করলে বিনা বাধায় বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র হন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে নির্বাচন না দিয়ে ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ডিসিসিকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। নির্বাচন কমিশন ২০১২ সালের ২৪ মে দুই ডিসিসির নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করে তফসিল ঘোষণা করে। কিন্তু উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের পর ওই নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৩ সালের ১৩ মে উচ্চ আদালত নির্বাচনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচন হয়নি।
ময়মনসিংহ আলাদা বিভাগ হচ্ছে : মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহকে পৃথক বিভাগ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এটি করা হলে ওই অঞ্চলের মানুষকে সব কাজের জন্য ঢাকায় ছুটে আসতে হবে না। অবশ্য ময়মনসিংহকে আলাদা বিভাগ করা নিয়ে কিছুটা হতাশাও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, যদিও অনেকেই এ কাজের বিরোধিতা করবেন। কারণ তারা ঢাকার সঙ্গেই থাকতে চান। তারপরও ময়মনসিংহকে আলাদা বিভাগ করতে হবে। বিভাগ করার আগে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম চালু করা হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে রসিকতা : ইরানের রাজধানী তেহরান সফরের বিষয়ে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, সে দেশটি বাংলাদেশের জন্য ভালো শ্রমবাজার হতে পারে। তেহরান সফরকালে তিনি এসব বিষয়ে সে দেশটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে বৈঠকে জানান। ইনু বলেন, তেহরান পারস্পরিক স্বার্থে ঢাকার সহযোগিতা কামনা করেছে। ইরান সফরকালে সেখানে ওআইসি মহাসচিবের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং মহাসচিবের একটি অনুরোধের বিষয়ে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, কসোভোর স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে ওআইসি মহাসচিব অনুরোধ জানিয়েছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার আগে দেখতে হবে অন্য মুসলিম দেশগুলো কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে কিনা?
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইরানের রাজবংশের শেষ শাহ বা রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করেন। প্রতাপশালী ওই রাজা অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৭৯ সালের ১৭ জানুয়ারি সিংহাসন ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ মিসরে পালিয়ে যান। পরে ১৯৮০ সালের জুলাইয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অর্থমন্ত্রী রেজা শাহর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি জানালে এক মন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, বয়স বাড়লে যে মেমোরি বাড়ে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আপনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রসিকতায় অংশ নিয়ে জানতে চান, সিনিয়র ও জুনিয়র কেবিনেট মিনিস্টার কে কে? তখন অন্যরা বলেন, সিনিয়র আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং জুনিয়র শাহরিয়ার আলম। পরে এটি সংশোধন করে বলা হয়, শাহরিয়ার আলম নয় জুনাইদ আহমেদ পলক। ওই সময় মন্ত্রীদের কেউ কেউ আপত্তি জানান। তারা বলেন, শাহরিয়ার বা পলক কেউ নয়, কারণ তারা কেবিনেট মিনিস্টার নন, স্টেট মিনিস্টার। তখন বয়স হিসাব করে পাওয়া যায়, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জুনিয়র কেবিনেট মিনিস্টার। কিন্তু এবার বাদ সাধেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। হাসিমুখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আনিসুল হক নয়, মুজিবুল হক সবচেয়ে জুনিয়র কেবিনেট মিনিস্টার। তার এই তথ্যে পুরো সভা কক্ষে হাসির রোল পড়ে যায়।
সৈয়দ আশরাফকে তিরস্কার : স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি খুলনায় এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিসা দেশাই বিসওয়াল এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। নিশা দেশাই বিসওয়ালকে দুই আনার মন্ত্রী এবং ড্যান মজিনাকে কাজের মেয়ে মর্জিনা বলে সম্বোধন করলে তা গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কাও করা হয়। জানা গেছে, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার এ ধরনের বক্তব্য কখনোই কাম্য নয়। তিনি নারীদের সম্মান দিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন আশরাফকে। শেখ হাসিনা বলেন, এতদূর থেকে তিনি (নিশা দেশাই বিসওয়াল) এসেছেন, তারপর তিনি একজন মন্ত্রী, একটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। একজন নারী হিসাবেই তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত। সৈয়দ আশরাফকে সতর্ক করে শেখ হাসিনা বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়ে আরেক দেশের মন্ত্রী সম্পর্কে তার এ ধরনের বক্তব্য দেয়া ঠিক হয়নি। এ সময় পুরো মন্ত্রিসভার বৈঠকে পিনপতন নীরবতা ছিল। সৈয়দ আশরাফের মুখও ছিল বেশ ভারি। তিনি কোনো যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেননি।
মালদ্বীপে পানি : মন্ত্রিসভায় সার্কভুক্ত মুসলিম দেশ মালদ্বীপে পানি পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সোমবার জাহাজে সমুদ্র পথে এ পানি পাঠানো হয়। মালের একমাত্র পানির পাম্পটি বিকল হয়ে গেলে সেখানে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ দেশটিকে সহযোগিতায় এগিয়ে এলো।

No comments

Powered by Blogger.