তারেকের ৩ ঘণ্টা জবানবন্দি

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ‘সেভেন মার্ডার’ অভিযান শেষে র‌্যাব সদস্যদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিতে মেজর (অব.) আরিফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এ নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। আরিফের নেতৃত্বে ৭টি লাশ ডুবিয়ে র‌্যাব সদস্যরা ফিরে আসার পথে গভীর রাতে নৌকাঘাটে তারেক নিজেই হাজির হন। তিনি সেখানে সৈনিকদের উদ্দেশে ব্রিফ করেন। ঘটনার গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ‘সমস্যা নাই’। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত অপহরণ ও খুনের আদ্যোপান্ত জানতেন তিনি। মূলত তার নির্দেশেই এই অপহরণের ঘটনা ঘটে বলে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে জবানবন্দিতে তিনি ‘কৌশলী শব্দ’ ব্যবহার করেছেন। ঘটনার বিস্তারিত খোলাসা করলেও তিনি ‘খুনের নির্দেশ’ দেয়ার বিষয়টি কোথাও বলেননি। তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ৩২ দিনের রিমান্ড শেষে ১৮ জুন নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কেএম মহিউদ্দীনের আদালতে দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ধরে এই জবানবন্দি দেন। ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় কঠোর গোপনীয়তায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সম্প্রতি একটি বিশেষ সূত্রে তারেক সাঈদের এই জবানবন্দির কপি যুগান্তরের কাছে এসেছে। জবানবন্দির পুরো অংশ নিচে দেয়া হল।
‘আমি র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর যোগদান করি। আমি র‌্যাব-১১ কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে নজরুলকে (প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম) গ্রেফতারের নির্দেশ দিই। ওই সম্মেলনে নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আমি লে. কমান্ডার রানাকে বলি সে যেন মেজর আরিফকে এ বিষয়ে সাহায্য করে। ২৭ এপ্রিল বেলা অনুমান ১১টার দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, ‘স্যার নজরুল আজকে কোর্টে আসবে। তাকে আজ গ্রেফতার করা যাবে।’ তখন আমি নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আরিফকে অনুমতি দিই। দুপুর ১২টার দিকে লে. কমান্ডার রানা আমাকে ফোন করে। সে নজরুলকে গ্রেফতারের বিষয় মেজর আরিফকে সাহায্য করার জন্য আমার কাছে অনুমতি চায়। আমি তাকে অনুমতি দিই। ওইদিন আনুমানিক ২টার (দুপুর) সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, ‘স্যার টার্গেট picked up (ধরা হয়েছে)। সঙ্গে আরও ৪ জন আছে। সবাইকে নিয়ে নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পে যাচ্ছি।’ তখন আমি আরিফকে বলি, ঠিক আছে যাও। বেলা আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের দিকে লে. কমান্ডার রানা আমার রুমে আসে। সে বলে, ঘটনাস্থলে একটি গাড়ি পড়ে আছে। ওই গাড়িটি সরাতে হবে। সেজন্য একজন ভালো ড্রাইভার লাগবে। তখন আমি রানাকে ব্যাটালিয়ন থেকে একজন ভালো ড্রাইভারকে নিয়ে যেতে বলি। বেলা অনুমান ৩টার সময় আরিফ আমাকে রিপোর্ট করে, সে নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পে পৌঁছে গেছে। তখন আমি বলি ঠিক আছে।
জবানবন্দিতে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তারেক আরও বলেন, ‘ওইদিন (ঘটনার দিন) আনুমানিক ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে লে. কমান্ডার রানা আমাকে দুবার ফোন করে বলে, ঘটনাস্থল থেকে যে গাড়িটি এনেছি, সেই গাড়িটি accident করেছে এবং গাড়িতে গ্যাস কম আছে। এই গাড়ি নিয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়া যাবে না। গাড়িটি ঢাকার কোথাও রাখতে হবে। তখন আমি রানাকে বলি গাড়ির ব্যাপারে আরিফ সব জানে। যা-ই কর আরিফকে জানিয়ে কর। ওইদিন আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টার দিকে রানা আমাকে ফোন করে বলে, স্যার গাড়ির বিষয়ে আরিফের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি গাড়িটি নিকেতনে রেখে যাচ্ছি। তখন আমি রানাকে বলি ওইভাবে গাড়ি রেখে তাড়াতাড়ি নারায়ণগঞ্জে চলে আস।’
তিনি বলেন, ‘রাত ৮টার সময় আমি নজরুলের স্ত্রী ও শ্বশুরের জন্য আমার অফিসে অপেক্ষা করছিলাম। ওই সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, ‘স্যার আমার লোক বদলি করতে হবে। আপনি একটি গাড়ি দেন।’ তখন আমি আরিফকে নরসিংদী ক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে একবারেই নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরতে বলি। তখন আরিফ জানায়, সে নরসিংদী ক্যাম্পে নেই। নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজ তাকে ঠিকমতো accept (গ্রহণ) না করায়, সে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেছে। তখন আমি আরিফকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি ও তোমার লোকজন কোথায় খাওয়া-দাওয়া করেছ? তখন আরিফ আমাকে জানায়, ‘স্যার আমি আমার লোকদের খাইয়েছি। আসামিরা এখন ঘুমাচ্ছে। আমি আমার লোকদের খাওয়ানোর জন্য সুরুজ স্যারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি।’ রাত ৮টার পর থেকে রাত ৯টার আগ পর্যন্ত আমি নজরুলের স্ত্রী, নজরুলের শ্বশুর ও নজরুলের আরও ১০-১২ জন লোকের সঙ্গে মিটিং করি। ওই সময় নজরুলের শ্বশুর ও স্ত্রী বলে, নূর হোসেন নজরুলকে অপহরণ করেছে। নূর হোসেনকে গ্রেফতার করলে নজরুলকে পাওয়া যাবে। তখন আমি বলি, তদন্ত সাপেক্ষে নূর হোসেনকে গ্রেফতার করা হবে। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, ‘স্যার রাস্তায় পুলিশের কড়া চেকিং চলছে। আমি Civil (বেসামরিক) গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এলে চেকিংয়ে পড়ব। স্যার, তাই আমার ক্যাম্পে ফেরার জন্য নৌকা দরকার। তখন আমি আরিফকে বলি, লে. কমান্ডার রানার সঙ্গে কথা বলে তুমি Boat (নৌকা) ঠিক করে নাও। র‌্যাব-১১ এর সব বোট লে. কমান্ডার রানা তত্ত্বাবধান করতেন। এরপর আমি বোটের বিষয়ে রানা এবং আরিফ দু’জনের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমন্বয় করে নিতে বলি। রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে লে. কমান্ডার রানা আমার অফিসে এসে আমার Land Phone থেকে মেজর আরিফকে দুবার ফোন করে এবং Boat Operator-কে ফোন করে মেজর আরিফ ও Boat Operator-এর মধ্যে সমন্বয় করে দেন। ওই সময় আমি রানাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আরিফ Boat কোথায় নিতে বলেছে? তখন রানা বলে, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নিতে বলেছে। রাত ১১টা ১৫ মিনিটের দিকে আরিফ আমাকে ফোন করে বলে, স্যার আমি কাঁচপুর পৌঁছে গেছি। তখন আমি বলি ঠিক আছে। আমি আমার রানারকে (বার্তাবাহক) ফোন করে বলি, তুমি আমার গাড়ি নিয়ে আস। তারপর আমি আমার ব্যাটালিয়ন Ops Officer (অপারেশন কর্মকর্তা) ASP (সহকারী পুলিশ সুপার) শাহরিয়ারকে ফোন করে বলি, মেজর আরিফের গাড়ি ও ব্যাটালিয়ন থেকে একটি মাইক্রোবাস নৌকা ঘাটে পাঠিয়ে দাও। রাত আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটের দিকে আমি নৌকাঘাটে পৌঁছি। আমি নৌকাঘাটে পৌঁছার ২০-২৫ মিনিট পর মেজর আরিফ নৌকাঘাটে পৌঁছাই। ওই সময় ASP শাহরিয়ার মেজর আরিফের গাড়ি ও একটি মাইক্রো নৌকাঘাটে পাঠিয়ে দেয়। তখন আরিফ বলে, ‘স্যার আসামিদের মেরে ফেলেছি।’ তখন আমি আরিফকে বলি, ‘মেরে ফেলছ, মানে? কেন মেরেছ?’ তখন আরিফ বলে, নজরুল আমাকে চিনে ফেলেছে তাই আমি নজরুলকে মেরে ফেলেছি। অন্যরা দেখে ফেলেছে তাই ভয়ে তাদেরও মেরে ফেলেছি। ওই সময় আরিফ জানায়, মোট ৭ জনকে মেরেছি। তখন আমি বলি, ৭ জন মানে? তুমি তো গ্রেফতার করেছ ৫ জনকে, অন্য ২ জন কোথায় পেলে। তখন আরিফ আমাকে বলে, ‘স্যার আমার গাড়িতে ছিল ৫ জন। এই ৫ জনের বিষয়ে আমি আপনাকে রিপোর্ট দিয়েছি। পেছনে আর একটি গাড়িতে রানা স্যার ২ জনকে পাঠিয়েছেন। এই ২ জনের বিষয়ে আপনাকে জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম ক্যাম্পে এসে জানাব।’ এই কথা শুনে আমি আরিফের Team-এর সৈনিকদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন আমি নিচে নেমে সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের আশ্বস্ত করি, সমস্যা নেই Officer গাড়িতে ছিল। তারপর আমি সব সৈনিকের কাছ থেকে আরিফকে মোবাইল নিয়ে নিতে বলি এবং আরিফসহ তার লোকদের গাড়িতে উঠতে বলে র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে যেতে বলি। তখন ASP শাহরিয়ার কর্তৃক পাঠানো মাইক্রোবাসের ড্রাইভার এসে বলে, ‘স্যার এই গাড়ির ইঞ্জিন দুর্বল, ঢাকায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমি মাইক্রোবাস নিয়ে মেসে যাচ্ছি।’ মেসে যাওয়ার পথে রাস্তায় পুলিশ আমার মাইক্রোবাস চেক করে। পরে আমার পরিচয় জানার পর পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। ২৯ এপ্রিল বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে আমি ও মেজর আরিফ অতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশনের (এডিজি অপস) অফিসে যাই। তিনি মেজর আরিফ ও নূর হোসেনের মধ্যে কথোপকথনের সিডি ও লিখিত ভার্সন আমাদের দেখান। ওই সময় অতিরিক্ত মহাপরিচালক আরিফকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এছাড়া আরিফ ও নূর হোসেনের কথোপকথনের মধ্যে কিছু সাংকেতিক শব্দ থাকায় অতিরিক্ত মহাপরিচালক স্যার আরিফকে ওই বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঢাকার ফ্ল্যাটের বিষয়ে সে বলে, ‘হ্যাঁ ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট আছে। নূর হোসেনের মাধ্যমে ফ্ল্যাটের টাকা জমা দিই। নজরুলের সঙ্গে নূর হোসেনের শত্রুতা থাকায় সোর্স হিসেবে নূর হোসেনকে ব্যবহার করি। র‌্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে বের হয়ে আমি ও আরিফ বিকালে আনুমানিক ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। ওইদিন বিকাল ৫টায় আমি আরিফ ও রানা মাতৃবাহিনীতে ফেরত যাওয়ার আদেশ পাই। রাত ৮টার মধ্যে যার যার মাতৃবাহিনীতে যোগদান করি।
২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ তার প্রাইভেট কার চালক জাহাঙ্গীর, বন্ধু তাজুল, স্বপন ও লিটন এবং প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার প্রাইভেট কার চালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করে র‌্যাব। এর তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং পরদিন আরও একজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.