রাজনীতিতে ঝড়ের আভাস by সাজেদুল হক

এমন ঘোষণা নতুন কিছু নয়। ছয় বছর ধরে বারবারই হুঙ্কার দেয়া হয়েছে আন্দোলনের। দেশের কোথাও কোথাও তুমুল আন্দোলন হয়েছেও। তাতে মসনদে কোন হাওয়া লাগেনি। তবে বিরোধী জোটের নতুন করে আন্দোলনে নামার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির অন্দরমহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। আরও কিছু ঘটনা সে কৌতূহলের পালে বাতাস দিয়েছে ভালমতোই। ঝড়ের পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। কি হবে জানুয়ারি-মার্চে? আদৌ কি বিরোধী জোট কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে? কেমন হবে সে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি কোন দিকে এগোবে? রাজনীতিতে জিয়া পরিবার কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? নাকি গ্রেপ্তার হয়ে যাবেন খালেদা জিয়া? জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় কখন কার্যকর হবে? জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে অবসরে যাবেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। নতুন প্রধান বিচারপতি কে হবেন- সেদিকেও দৃষ্টি রাখবেন পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেবে। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কি কোন প্রভাব পড়বে? এরইমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। বৈঠকে বর্তমান সংসদের কার্যকারিতা ও বিরোধী দলের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। দৃশ্যত ভারত, চীন, রাশিয়ামুখী নীতি অবলম্বন করছে আওয়ামী লীগ সরকার। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের প্রতি এসব বৃহৎ শক্তির এক ধরনের সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মনে করে না। এ অবস্থায় নতুন নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই আন্দোলনে নামছে বিএনপি জোট। এর আগে চলতি মাসেই একাধিক গণসংযোগমূলক কর্মসূচি মার্চের মাধ্যমে আন্দোলন প্রস্তুতিতে গতি আনার চেষ্টা করা হবে। আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন এরই মধ্যে দলের নেতা, উপদেষ্টা, বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের মতামত গ্রহণ করেছেন। তবে আন্দোলন নিয়ে বিএনপির পরামর্শদাতাদের দুই ধরনের মত রয়েছে। একদল মনে করে, সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচির মাধ্যমেই সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি যত দূর সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে অন্য একটি অংশ মনে করে, সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কোন সুফল মিলবে না। তারা মনে করেন, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের পর কার্যকর অবরোধ অব্যাহত রাখতে পারলে সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারতো না। কর্মীরা মাঠে নামলেই পুুলিশ গুলি করলে সহিংসতা এড়ানো খুব কঠিন বলেও মনে করেন তারা। তবে সাধারণ জনগণের ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয় সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শও তাদের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন-পূর্ববর্তী আন্দোলনকে সহিংসতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে একাধিক সংস্থা কাজ করেছিল বলেও বিএনপির কেউ কেউ মনে করেন। আন্দোলন কর্মসূচি কেমন হবে সে ব্যাপারে খালেদা জিয়া নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে খোলাসা করে কিছু বলেননি। খুব অল্পসংখ্যক নীতিনির্ধারকের সঙ্গেই এ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তবে বিরোধী জোটের নীতিনির্ধারকরাই সামনের তিন মাসকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তারা মনে করেন, কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে এ সময়ের মধ্যেই সুফল পাওয়া সম্ভব। না হয় আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত হবে। বিএনপির পরামর্শদাতাতের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যে সরকারটি আছে তারা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অনৈতিক সরকার। এ সরকারকে চলে যেতে হবে, বিদায় নিতে হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারকে বিদায় নিতে হবে। আর সে কথাই তারা বলছেন। তবে সরকার কিভাবে চলে যাবে সেটি একটি প্রশ্ন। এর উত্তর হচ্ছে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার চলে যাবে। বিএনপি নেতারা যে মার্চের কথা বলছেন সে সম্পর্কে বলবো, এই শীতকালটাকে যদি সরকার পার করতে পারে তাহলে অনেকের ধারণা সরকার আরও একটি বছর ক্ষমতায় থেকে যাবে। ফলে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল খুবই চেষ্টা করবে যাতে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে স্বচ্ছ একটি নির্বাচন আদায় করে নিতে পারে। আর সে কারণেই এখন বিএনপি নেতাসহ অন্য নেতাদের কাছ থেকে এ ধরনের কথা উঠছে।’ তবে কঠোর হস্তে আন্দোলন দমনের পাশাপাশি আন্দোলনের সময় অন্য ইস্যু সামনে নিয়ে আসার পুরনো খেলা নতুন করে শুরু হতে পারে বলেও মনে করেন কোন কোন পর্যবেক্ষক। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি আবারও নতুন করে সামনে চলে আসতে পারে। মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময়টিও হবে গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ইস্যুুটিও নতুন করে সামনে আনা হচ্ছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বেগম খালেদা জিয়ার অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটির দিকেও তীক্ষ্ন নজর রাখছেন। এ মামলায় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী গ্রেপ্তার হতে পারেন- এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে। খোদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ও এ আশঙ্কার কথা বলেছেন। সরকার আপাতত মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে চিন্তা না করলেও একটি মাইনাস থিওরি নিয়েও রাজনীতিতে আলোচনা রয়েছে। খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিরোধী রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার তত্ত্ব সফলতার মুখ দেখলে মধ্যবর্তী নির্বাচন হতেও পারে। সব দিক দেখেই হিসাব কষছেন খালেদা জিয়া। হয় এবার, না হয় কখনওই নয়। এ ধারণার ওপর নির্ভর করেই আন্দোলনে নামছে বিরোধী জোট। এ আন্দোলনের ফল দেখতে হয়তো বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকঃ সংসদ কতটা কার্যকর জানতে চেয়েছে ইইউ
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। গতকাল বিকালে দুই দলের নেতাদের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের পৃথক বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের পর দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জানিয়েছেন, বৈঠকে বর্তমান সংসদের কার্যকারিতা ও বিরোধী দলের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বক্তব্যে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলেও দাবি করেন হানিফ। গতকাল বিকাল সাড়ে চারটার পর ধানম-স্িথ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক শুরু হয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে হানিফ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সংসদের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ইইউ। আওয়ামী লীগ সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। বৈঠকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, কোন আলোচনা হয়নি। প্রতিনিধি দলের আগ্রহ ছিল পোশাক খাত ও দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে। বৈঠকে হানিফ ছাড়াও দলের অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, দলের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। ইইউ’র চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ইইউ সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য জেন ল্যাম্বার্ট।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। বেলা আড়াইটা থেকে ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ভাবনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সেখানে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে সরকার
বর্তমান সরকারকে অবৈধ আখ্যায়িত করে যে কোন মুহূর্তে তাদের সিংহাসন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ১৯ নেতাকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে গতকাল দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। মির্জা আলমগীর বলেন, ভোটারবিহীন সরকারের নির্মম দেশ শাসনে অতিষ্ঠ দেশবাসী। তাদের বিষাক্ত ছোবলে মরণবেদনায় কাতরাচ্ছে। অবৈধ সরকার তাদের জুলুম নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হত্যা-গুমের রক্তাক্ত পথে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। নিষ্ঠুর নিপীড়নের একদলীয় দুঃশাসনের পরিণতি থেকে আওয়ামী লীগ কখনও শিক্ষা নেয়নি। তিনি বলেন, অবৈধ সরকার ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। কারণ গণভিত্তিহীন অবৈধ ক্ষমতার সিংহাসন যে কোন মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভূমিতলে পতিত হবে। জনগণের আন্দোলনের জোয়ারে এই অবৈধ সরকারের বিদায় নিশ্চিত হবে। অবিলম্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। এদিকে যুবদল কেন্দ্র্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের গুলশানের বাসায় পুলিশি তল্লাশির নামে আসবাবপত্র তছনছ এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অশালীন আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন মির্জা আলমগীর।

No comments

Powered by Blogger.