হট্টগোলের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ

তুমুল বাকবিতণ্ডা আর হই-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক বাসুদেব রায় সোমবার এ সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তবে চেঁচামেচির কারণে সাক্ষী তার সাক্ষ্যে কী বলেছেন তা কেউই স্পষ্ট শুনতে পাননি। এর আগে আদালতের প্রতি আস্থা নেই জানিয়ে মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের করা তিনটি আবেদন নামঞ্জুর করে দেন আদালত। আদালত ১৭ ডিসেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
সোমবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন বিচারক বাসুদেব রায়। এরপর কয়েক দফা বাকবিতণ্ডার মাঝেই আধা ঘণ্টার বিরতি দিয়ে দীর্ঘ চার ঘণ্টা শুনানি চলে। বেলা সাড়ে ৩টায় শুনানি শেষ হয়। শেষ মুহূর্তে সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করায় এবং আসামিপক্ষের বক্তব্য সম্পন্ন করার আগেই সাক্ষী শুরুর নির্দেশ দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। অন্যদিকে সাক্ষ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীরাও এ সময় চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বাকবিতণ্ডার মাঝেই কয়েক মিনিট সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন মামলার বাদী ও দুদকের উপপরিচালক হারুনুর রশীদ। পরে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, পরবর্তী তারিখে আবার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, সাক্ষী আদালতে কি বলেছেন, তা তারা বুঝতে পারেননি।
এদিকে কাঠগড়া থেকে নামার পর মামলার বাদী হারুনুর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, এজাহার থেকে একটি প্যারা পড়ে শুনিয়েছি। কেউ শুনতে পায়নি বলে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মাইকে বলেছি, জোরে বলেছি, গলা ফাটাইয়া বলেছি। জজ নোট করেছেন। আমার বলা দরকার, বলেছি।
এদিকে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ উপলক্ষে সোমবার আদালতের ভেতরে ও বাইরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। চারপাশে ব্যাপক পুলিশি প্রহরা নেয়া হয়। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।
তাদের সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান। এ ছাড়া এদিন খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোসলেহ উদ্দিন জসীম, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, অ্যাডভোকেট জামিল আখতার এলাহী, অ্যাডভোকেট তাহেরুল ইসলাম প্রমুখ। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান, অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল প্রমুখ।
এজলাসে বিচারক আসন গ্রহণ করলে মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে চারটি আবেদন জমা দেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। আদালতের প্রতি আস্থা না থাকায় তা পরিবর্তনের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করা হয়েছে বিষয়টি জানিয়ে বিশেষ আদালতে কার্যক্রম মুলতবি চেয়ে দুটি আবেদন করা হয়। এ ছাড়া বাকি দুটি আবেদন করা হয় নিরাপত্তা প্রশ্নে খালেদা জিয়ার আদালতে না আসা প্রসঙ্গে। আদালত খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির আবেদন গ্রহণ করেন। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি চলতে থাকে।
উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত বলেন, খালেদা জিয়া নিরাপত্তার কারণে আসেন নি। তার আবেদন মঞ্জুর করছি। সরকারকে নিরাপত্তা পর্যাপ্ত করতে বলছি। আর মুলতবির বিষয়ে আগেও বলেছি। মুলতবির প্রার্থনা নামঞ্জুর করছি। এ সময় আইনজীবীদের উদ্দেশে বিচারক আরও বলেন, আদালতের পরিবেশ আপনারা রক্ষা করবেন। আইনশৃংখলা বাহিনীকে যেন দরকার না হয়। সাক্ষী উপস্থাপনের নির্দেশ দিচ্ছি। বিচারকের এমন বক্তব্যের পর সাক্ষী কাঠগড়ায় যান। এজাহার পড়ার প্রস্তুতি নেন।
এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, আমাদের আরও বক্তব্য আছে। দরখাস্ত আছে। এ সময় আদালত বলেন, আমি শুনব। পেছন থেকে কথা বলবেন না। এ পর্যায়ে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপনি আমাদের আবেদনের (সময় চেয়ে) ওপর আদেশ দেন। আপনি আমাদের আবেদন খারিজ করছেন। তবে তার ভিত্তি আছে কিনা তা আমাদের পরীক্ষা করার সুযোগ দেন। জয়নুল আবেদিন বলেন, সাক্ষী কাঠগড়ায় থাকলে আমাদের দ্বিতীয় আবেদন (সময়ের আবেদন পুনর্বিবেচনা) কোনো অর্থ বহন করবে না। তাই তাকে এখানে (কাঠগড়ায়) রাখা যাবে না। এ সময় বিচারককে উদ্দেশ করে জয়নুল আবেদিন আরও বলেন, আপনি যেভাবে সাক্ষী উঠাচ্ছেন এভাবে নিয়ম নেই। আজ আপনি যেভাবে সাক্ষী উঠালেন, আদালত পরিবর্তনের আবেদন করতে এটাও একটা ভিত্তি হতে পারে।
বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে আদালত নামাজ ও মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দেন।
বিরতি শেষে বেলা আড়াইটার দিকে আদালত আবার শুরু হয়। এ সময় সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আপনি মুলতবি খারিজ করে (আগের দিনের একটি আবেদনে) যে আদেশ দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে আমরা হাইকোর্টে যাব। এ বিষয়ে আবেদন দিচ্ছি এবং আবার মুলতবির আবেদন করছি। এ সময় দুদকের আইনজীবী কাজল বলেন, আসামিপক্ষ বক্তব্যের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করছে। আদালতকে তিনি বলেন, আদেশ দেন, আদেশ দেন। আমরা বিচার চাই। তারা (আসামিপক্ষ) চাচ্ছেন সময়। এমন কোনো গ্রাউন্ড তারা তৈরি করতে পারে নাই যাতে সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ থাকতে পারে। এরপর আসামিপক্ষে জয়নুল আবেদিন আবার বক্তব্য শুরু করেন। মাঝপথে আদালত তাকে জিজ্ঞাসা করেন, শেষ হয়েছে আপনার? জবাবে জয়নুল আবেদিন বলেন, আমরা আদালতকে সাহায্য করতে এসেছি। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, আমার যা শোনা হয়েছে তা যথেষ্ট। এ সময় আদালত খালেদা জিয়ার পক্ষে করা আরও একটি আবেদন নামঞ্জুর করে বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
তার এ আদেশের পর আদালতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তারা কার্যক্রম মুলতবি করতে আদালতের কাছে আর্জি জানাতে থাকেন। এদিকে সাক্ষ্য চালিয়ে যেতে চেঁচামেচি শুরু করেন দুদকের আইনজীবীরাও। হইচইয়ের মাঝেই সাক্ষীকে কাঠগড়ায় ওঠানো হয়। তিনি কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনো কথাই শোনা যচ্ছিল না।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের পুলিশ সদস্যরা ব্যারিকেড দিয়ে রাখেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। আদালত এর মাঝেই সাক্ষীকে উদ্দেশ করে বলেন, বলতে থাকেন। এদিকে হই-চইয়ের মাঝেই দুদকের আইনজীবী রফিকুল হক বেনু সাক্ষীকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন, আপনি খালি ঠোঁট নাড়েন। পরেরটা পরে দেখা যাবে। উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামক দুটি দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন এই বিশেষ জজ আদালত-৩-এ। এ মামলা খালেদা ছাড়াও তার বড় চেলে তারেক রহমানসহ নয়জন আসামি হিসেবে রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.