লিমা জলবায়ু সম্মেলন সফল হবে কি? by সালমা ইসলাম

গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে শিল্পোন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে যে মতপার্থক্য দেখা দেয়, তাতে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ উদ্বিগ্ন হয়। পেরুর লিমায় চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে গত কয়েকদিনেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে ইতিবাচক কোনো খবর মেলেনি। বস্তুত কোপেনহেগেন সম্মেলনসহ এ বিষয়ক গত কয়েক বছরের বিভিন্ন সম্মেলনের হতাশা বিশ্ববাসী এখনও ভুলতে পারেনি। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিভিন্ন আলোচনায় প্যারিস সম্মেলনে যে চুক্তি হওয়ার কথা, তা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়। গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে প্যারিস সম্মেলনে ইতিবাচক প্রাপ্তির বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়। প্যারিস সম্মেলনে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধবিষয়ক যে প্রটোকল বা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা, তার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখার খসড়া প্রণয়নের কাজটি লিমা সম্মেলনে সম্পন্ন হওয়া দরকার। তা না হলে প্যারিস সম্মেলনে এ বিষয়ক চুক্তি সম্পাদনে নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে শেষ পর্যন্ত প্যারিস সম্মেলনেও চুক্তি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্বের শীর্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে যেসব ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাতে আমরা আশাবাদী যে, ২০১৫ সালে প্যারিস সম্মেলনে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা পূরণ হবে। ওই সম্মেলনে চুক্তিটি যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য প্রস্তুতিমূলক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কিয়োটো প্রটোকল বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে যে ধরনের গড়িমসি লক্ষ করা গেছে, আগামীতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।
২.
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের সব দেশই কম-বেশি ক্ষতির শিকার হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল আইপিসিসির (The Intergovernmental Panel on Climate Change) বিশেষজ্ঞদের অভিমত- বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা ৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৮২ সেন্টিমিটার বা ৩২ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সামুদ্রিক ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা যে আরও বেড়ে যাবে- এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে বহুবার সতর্ক করেছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে বিশ্ববাসীকে যেসব আকস্মিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হবে তা ইতিমধ্যে বহুবার আলোচিত হয়েছে এবং এ আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হল, এত আলোচনার পরও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।
শিল্প বিপ্লবের পর শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হওয়া শুরু হওয়ার পর সে ধারা অব্যাহত থাকার অন্যতম কারণ প্রযুক্তি খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হওয়া। এ প্রেক্ষাপটে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়ার জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা অব্যাহত রাখা জরুরি।
২০০৭ সালে প্রকাশিত আইপিসিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ুর উষ্ণতা যে বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং একই সঙ্গে আগাম এ সতর্কবার্তা দেয়া হয় যে, যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে ২১০০ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। আইপিসিসির সতর্কবার্তায় বর্ণিত বিষয়গুলো মিডিয়ায় বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হলেও বিগত দিনগুলোতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আইপিসিসির সভাপতি রাজেন্দ্র পাচৌরী তখন বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বের সবাইকেই কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করবে। তার এ সতর্কবার্তা প্রকাশের পর বিশ্ববাসী নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনসহ এ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফল করতে জোরালো ভূমিকা রাখবে, এটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে তা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্বের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে মেরু অঞ্চলের বরফসহ হিমবাহ বা তুষার স্রোত গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। সারা বিশ্বে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব কত দীর্ঘস্থায়ী হবে- এ বিষয়টিও বহুল আলোচিত। কিন্তু এসব আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিশ্বের শীর্ষ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী শিল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
৩.
গত কয়েকশ’ বছরে বিভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র মাত্রার সামুদ্রিক ঝড়গুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বয়ে গেছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ওপর দিয়ে। প্রাণঘাতী সেসব ঝড়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বিপুলসংখ্যক গৃহপালিত পশু প্রাণ হারিয়েছে এবং বিপুল অংকের সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। গত কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসে যেসব সামুদ্রিক ঝড়ে অধিকসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এমন বিশটি ঝড়ের নয়টিই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট হয়, তীব্রমাত্রার সামুদ্রিক ঝড়ের কারণে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন কতটা হুমকির মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘গ্রেট ভোলা সাইক্লোন’ নামের সামুদ্রিক ঝড়ে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে- বিভিন্ন সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বিবেচনায় নিলেও অনুমান করা যায়- ওই ঝড়ে কী বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭৩৭ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। বিভিন্ন সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও ওই ঝড়ে যে আরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ আধুনিক প্রযুক্তির এত বিকাশের পরও সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন এলাকার ঝড়ের পরবর্তী সময়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যগুলো বিবেচনায় নিলেই বিষয়টি আমাদের সামনে বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিডিয়ায় প্রকাশিত কোনো সামুদ্রিক ঝড়ের দু’দিন পরের তথ্য এবং কয়েকদিন পরের তথ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ১৫৮৪ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’ নামে পরিচিত সামুদ্রিক ঝড়ে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। প্রকৃতপক্ষে সামুদ্রিক ঝড়ে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ প্রযুক্তির এত বিকাশের পরও কোনো সামুদ্রিক ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র জানতে আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
৪.
বিভিন্ন দেশে শহরমুখী মানুষের স্রোত বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কী কী সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, এসব দীর্ঘদিন আলোচিত হলেও শহরমুখী মানুষের স্রোত বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সামুদ্রিক ঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ সব হারিয়ে শহরে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। উন্নত দেশগুলো এ ধরনের পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো তা পারে না। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিলে যানজটসহ অন্যান্য সমস্যা কী প্রকট আকার ধারণ করবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ অবস্থায় বৈশ্বিক উষ্ণতা যাতে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫.
সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে বিশ্বজুড়ে কয়লার ব্যবহার কমছে না। শিল্পোন্নত দেশগুলোর উচিত কয়লার ব্যবহার কমিয়ে নিরাপদ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়ানো। গত দুই দশক ধরে এত আলোচনার পরও উচ্চমূল্যসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে না। ধারণা করা হচ্ছে- সারা পৃথিবীতে প্রধান জ্বালানি হিসেবে নিরাপদ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার চালু হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছতে অন্তত পঞ্চাশ বছর লাগবে। কিন্তু আগামী পাঁচ দশক যাবৎ বিভিন্ন দেশ থেকে বর্তমান হারে দূষণ নির্গত হলে সমুদ্রও ভয়াবহ দূষণের শিকার হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত দূষণসহ বিভিন্ন কারণে সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ দ্রুত কমছে। অবাধে মৎস্য শিকারের কারণেও সামুদ্রিক মাছের পরিমাণ কমছে। অবাধে বিপুল পরিমাণ মৎস্য শিকার এবং সমুদ্র দূষণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪৮ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে মাছ- এমন আশংকাও করেছেন একদল বিজ্ঞানী। অবশ্য অনেক গবেষক এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তবে সমুদ্রে মাছের পরিমাণ যে দ্রুত কমছে, এটা সাধারণ জেলে ও মৎস্য শিকারিরাই বুঝতে পারেন। অ্যানথ্রাক্স, বাডর্ফ্লুসহ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মাছের চাহিদা বেড়ে যায়। কাজেই আগে থেকে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে প্রয়োজনের সময় চাহিদা অনুযায়ী মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
৬.
বিভিন্ন গবেষণার ফল থেকে জানা যায়, উপকূলীয় এলাকার কাছাকাছি এবং অগভীর সমুদ্রেও মাছের পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যার প্রকৃত কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। এতে সর্বস্ব হারিয়ে দরিদ্র মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গমন করে। সর্বস্ব হারিয়ে এসব দরিদ্র মানুষ নিকটস্থ শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পেশা বদলের কারণে এদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। অনেকে কাজের খোঁজে রাজধানীতে এসে ভিড় করে। উপকূলীয় এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ রাজধানীতে এসে ভিড় করার বিষয়ও উদ্বেগজনক। কারণ রাজধানীর নতুন পরিবেশে তাদের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কত কঠিন তা সহজেই অনুমান করা যায়। ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তু দরিদ্র মানুষের কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। উপকূলীয় এলাকার এসব মানুষ কী করে নিজ এলাকায় বসবাস করতে পারে, সে উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি এতটাই জটিল আকার ধারণ করেছে যে, এ সমস্যার সমাধানে কেবল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের কয়েকদিনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা যথেষ্ট নয়। এ জটিল সমস্যার সমাধানে সারা বছর বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা দরকার। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কতভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তা যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে হবে।
৭.
একেকটি সামুদ্রিক ঝড়ের পরে উপকূলীয় এলাকায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা সিডরের সময় আমরা লক্ষ করেছি। সাধারণভাবে লক্ষ করা গেছে, অতীতে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে কোনো এলাকার ওপর দিয়ে সামুদ্রিক ঝড় বয়ে যেত। আর সাম্প্রতিক প্রবণতা হল, একই স্থানের ওপর দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে সামুদ্রিক ঝড় বয়ে যাওয়ার নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সামুদ্রিক ঝড়ের সময় উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে সবুজ বেষ্টনি তৈরির বিষয়টিও বহুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার মানুষের সুরক্ষার জন্য সবুজ বেষ্টনি তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন রোগের প্রকোপ বাড়বে। উন্নত দেশগুলো এ পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। যেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতি লোভ ও লাভের কারণেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে, তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর উচিত কেবল দায়সারাভাবে দায় স্বীকার না করে বিদ্যমান সংকট নিরসনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
৮.
যেকোনো প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা দ্রুত হারে বাড়তে পারে এবং এর প্রভাবে জনদুর্ভোগ বাড়তে পারে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা যাতে দ্রুত হারে না বাড়ে, এ বিষয়ে সবাই সতর্ক থাকবে, এটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে তা লক্ষ করা যায়নি। শুধু তাই নয়, মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়ে এত আলোচনার পরও শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস যেমন- কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লারো কার্বন- এসব বায়ুমণ্ডলে নির্গমনের হার কমছে না। বিভিন্ন গবেষণার ফল থেকে জানা যায়, গত প্রায় ১০০ বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ও তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় এক বছর আগে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ২০ লাখ বছরের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এসব তথ্য প্রকাশের পর বিগত বছরগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল শিল্পোন্নত বিভিন্ন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, এমনটি শোনা যায়নি।
৯.
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এত
আলোচনার পরও গত কয়েক বছরে বিশ্ব জলবায়ু
সম্মেলনে গতানুগতিক আলোচনা ছাড়া বিশ্ববাসীর উল্লেখযোগ্য কোনো অর্জন হয়নি। কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে যে নতুন সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত মানুষের সে আশা পূর্ণ হয়নি। এমনকি এর পর গত কয়েকটি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো
অগ্রগতি হয়নি। গত বছর পোল্যান্ডে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে একের পর এক হতাশার খবরে আমাদের উদ্বেগ বেড়েছে। অবশ্য শেষ মুহূর্তে সামান্য আশার আলো দেখা গিয়েছিল কপ-১৯ সম্মেলনে।
বিশ্বের অন্যতম কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো ইতিমধ্যে কার্বন নিঃসরণে যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়েছে, তারা সেসব প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিকতার পরিচয় দেবে, এ নিয়েও বিশ্ববাসীর বিশেষ কৌতূহল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সমাবেশে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন, তা কার্বন নিঃসরণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, এমনটাই
আশা করা যায়।
১০.
সিডরের সাত বছর পরও যেসব মানুষ মানবেতন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তাদের দুরবস্থা দূর করার উপায় কী, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে তুলে ধরতে হবে। সিডরের মতো একেকটি সামুদ্রিক ঝড়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেসব বিষয়ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বিশেষভাবে তুলে ধরা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে যেসব অর্থ অনুদানের কথা ঘোষণা করা হয়, ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ওই পরিমাণ অর্থ কত নগণ্য তাও বিবেচনায় আনা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন দেশগুলোর পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের বিষয়টি প্রতিবছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো কতটা উপকৃত হয়েছে, তা সিডরের সাত বছর পরও উপকূলীয় এলাকার মানুষের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়।
১১.
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে। অন্য আলোচনার পাশাপাশি এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার চরাঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার প্রান্তিক মানুষ বংশপরম্পরায় প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কোনো রকমে টিকে আছে। সিডর, আইলার মতো সামুদ্রিক ঝড়ে সব হারিয়ে উপকূলীয় এলাকার চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের অনেকেই বিভিন্ন শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাজধানীতে আশ্রয় নেয়। এদের একটি অংশের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হওয়ার আশংকা যে বেড়ে যায়, এটিও আলোচিত একটি বিষয়। এ ধরনের প্রকৃত জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা নিরূপণ জরুরি। এই উদ্বাস্তুদের সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনেও এ ইস্যুকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
শিল্প বিপ্লবের পর বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়েছে, এ নিয়ে বিশ্ববাসী বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত।
এখন জরুরি হল জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প পরিবেশবান্ধব
জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে সমন্বিত ও আঞ্চলিকভাবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির গবেষণায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
১২.
লিমা জলবায়ু সম্মেলন কতটা সফল হবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে- প্যারিস সম্মেলনে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধ বিষয়ক যে প্রটোকল সম্পাদিত হওয়ার কথা, এ বিষয়ে লিমা জলবায়ু সম্মেলনে কী অগ্রগতি হল তার ওপর। কারণ বিশ্ববাসীর বিশেষ দৃষ্টি এখন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধবিষয়ক পরবর্তী চুক্তির দিকে। প্যারিস সম্মেলনে যে চুক্তিটি হবে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হলে বিশ্ববাসীকে কী চরম মূল্য দিতে হবে- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগেই তা স্পষ্ট হচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে এসব দুর্যোগ আগামীতে আরও কত তীব্র হবে, এ বিষয়ে এখন থেকেই বিশ্ববাসীকে সতর্ক করতে হবে এবং আগামী প্রজন্মের সুস্থতার কথা বিবেচনা করে আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে আগামীতে সব দেশের টেকসই উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি : প্রকাশক, যুগান্তর

No comments

Powered by Blogger.