ছদ্মবেশে শত্রুর ঘাঁটিতে ঢুকে তথ্য আনতাম

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কখনও রণক্ষেত্রের অগ্রণী সৈনিক, আবার কখনও গোয়েন্দা ইউনিটের হয়ে ছদ্মবেশে শত্র“র ঘাঁটিতে ঢুকে পড়েছেন গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য। জীবন বাজি রেখে শত্র“র কাছ থেকে তথ্য এনে কমান্ডারের কাছে দিয়েছেন তিনি। এই দুঃসাহসিক কাজ করেছেন যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান। মান্নানের দেয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতেই হয়েছে শত্র“র ওপর হামলার পরিকল্পনা। একের পর এক আক্রমণে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে শত্রুপক্ষের আস্তানা। অবশেষে বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছে বিজয়ের গান। যুগান্তরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল মান্নান জানিয়েছেন যুদ্ধজয়ের সেই দিনগুলোর কথা। আবদুল মান্নানের স্মৃতিতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ তিনি করেছেন ১৯৭১ সালের ২৯ মে। সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তসংলগ্ন বড় বেড়িবাঁধে এ যুদ্ধ হয়। সেদিন দিনের ডিউটি শেষ করে ক্যাম্পে চলে আসেন আবদুল মান্নান। আরেক গ্রুপ ডিফেন্সের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট লম্বা ডিফেন্সের দক্ষিণে ইপিআর, মাঝামাঝি ছাত্ররা, উত্তরে আনসার মুজাহিদ বাহিনী অবস্থান করে। এ সময় ছাত্রদের কাছে ৩০৩ রাইফেল, আনসার মুজাহিদের কাছে ৩০৩ রাইফেল ও সিএমজি, ইপিআর ১১টি এলএমজি ও ১ টি এইজএমজি ছিল। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণের জবাব দিতে থাকে আনসার বাহিনী। এ সময় ক্যাপ্টেনের নির্দেশে সবাই ডিফেন্সে এসে অবস্থান নেয়। এরপর রাত ২টা ৩০ মিনিটের দিকে পাকবাহিনী গুলি করতে করতে ডিফেন্সের ছাত্রদের ৪-৫ ফুট কাছে চলে আসে। এ সময় আবদুল মান্নানসহ ছাত্র গ্র“পের অন্যরা পাকসেনাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। তুমুল যুদ্ধের একপর্যায়ে আনসার বাহিনী নীরব হয়ে পড়ে। নীরবতার সুযোগে পাকবাহিনী আরও এগিয়ে আসে। এ সময় গর্জে ওঠে ইপিআর বাহিনী। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় পাকসেনারা। এ আক্রমণে নিহত হয় অসংখ্য পাকসেনা। সিদ্ধান্ত হয় নিহত পাকসেনাদের লাশ আনতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক দু’জন মুক্তিযোদ্ধা ক্রুলিং করে পাকসেনার ৩টি লাশ নিয়ে আসেন। যুদ্ধশেষে সকালে ৩ পাকসেনার লাশ ডিফেন্স থেকে ঘোজাডাঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় আবদুল মান্নানকে। ডিফেন্স থেকে ক্যাম্পের দূরুত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। ৩০ মে সকালে লাশ ৩টি নিয়ে যখন ফিরছিলেন তখন রাস্তার দু’ধারে লোকে লোকারণ্য ছিল। সেদিন লাশের ওপর দাঁড়িয়ে অস্ত্র ঘাড়ে নিয়ে বীরবেশে ক্যাম্পে ফিরে আসেন তিনি। ক্যাম্পে লাশ রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসার সময় অনেক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক আবদুল মান্নানের সঙ্গে ডিফেন্সে আসেন। এরপর ভারতীয় জেনারেল ওই যুদ্ধের স্বীকৃতি দেন। তিনি ঘোষণা করেন, মুক্তিযোদ্ধারা আজ থেকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাবেন। বেশি বেশি খাবার পাবেন।
আবদুল মান্নান বলেন, ২৫ মার্চ পাকহানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর হামলা করলে আমি ও আমার সহযোগীরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কিছু দিন দেশে থাকার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের বনগাঁও চলে যাই। বনগাঁও’র মতিগঞ্জ হাইস্কুল ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর (ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক) কাছে আমরা ৬৫ জন ছাত্র নাম লেখাই। এ ক্যাম্পেই প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সাত দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ৪৫ জনের একটি টিম বাছাই করেন। তিনি এ টিমকে যশোরের শার্শা সীমান্তে অপারেশনে পাঠান। এ টিম সফলভাবে অপারেশন পরিচালনা করে। এরপর আমাদের এ-কোম্পানির ঘোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ক্যাম্প থেকেই প্রতিদিন রাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশন চালানো হতো। একই সঙ্গে ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করা হতো। এ টিমের ডিফেন্স ছিল সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তসংলগ্ন বড় বেড়িবাঁধ।
আবদুল মান্নান জানান, পরবর্তী সময়ে দেরাদুন থেকে হায়ার ট্রেনিং নিয়ে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট হয়ে দেশে এসে বিএলএফের বৃহত্তর যশোর জেলার প্রধান আলী হোসেন মনির নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আরবপুর, দেয়াড়া, চুড়ামনকাটি, চাঁচড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের যুবদের মুক্তিযদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। এ সময় তিনি ১৪-১৫ গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। তাদের নিয়ে ছোটখাটো বেশ কয়েকটি অপারেশন চালান। তার উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে রয়েছে যশোর ক্যান্টনমেন্টে এলাকার বিমানবন্দর পোস্ট অফিসের পোস্টবক্সের চিঠি চুরি করে আনা। কাজটি অত্যন্ত কৌশলে করতে হয়েছিল। সফলতার সঙ্গে কাজটি করতে সক্ষম হন আবদুল মান্নান। আবদুল মান্নান শহরের নতুন খয়ের তলা এলাকায় বসবাস করেন। দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। শহরের মান্নান প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি ছাপাখানা রয়েছে। এ ব্যবসার মাধ্যমে তিনি জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.