২০১৪: যারা অনন্তপথের যাত্রী by কাফি কামাল

মৃত্যু নিয়তির এক অমোঘ নিয়ম। জন্মালেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। কীর্তিমানের মৃত্যু জাতীয় জীবনে তৈরি করে গভীর শূন্যতা। যা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। সুন্দর ভুবনে তাদের বেঁচে থাকা প্রয়োজনীয় হলেও অমোঘ সত্যকে মেনে আমাদের উচ্চারণ করতে হয় ‘যেতে নাহি দিব। হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ প্রকৃতির নিয়ম মেনে ২০১৪ সালেও না ফেরার দেশে চলে গেছেন বেশ কয়েকজন কীর্তিমান। যাদের মধ্যে রয়েছেন বরেণ্য সব দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, বিপ্লবী, বিজ্ঞানী, আইনজ্ঞ, স্থপতি, চিত্রশিল্পী, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। স্বীয় কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যারা রেখেছেন দিগন্তবিস্তারী অবদান। ‘আমি যেমন এসেছিলাম, সঙ্গী ছাড়াই/ফিরব খালি হাতেই।/জমার খাতে কিছু যদি জমেই থাকে/থাক পড়ে তা এইখানে,/যদি কারও কোন সময় কাজে লাগে।’ কবিতার চরণগুলো ‘নব বসন্তে’র কবি খ্যাত বাংলা সাহিত্যের চল্লিশের দশকের কবি আবুল হোসেনের। ৯১ বছর বয়সে ২৯শে জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষাজীবনে অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী আবুল হোসেন বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে পালন করেছেন সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন দায়িত্ব। অলঙ্করণ করেছেন কলকাতা ও ঢাকার শীর্ষস্থানীয় নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের শীর্ষ পদ। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তার ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত এবং সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমী ও একুশে পদক। দার্শনিক ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম। ৮৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৫ই জুন। বরিশালের কৃষক পরিবারের এ সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও অধ্যাপনা করেন। সাম্যবাদী বামপন্থি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় পাকিস্তান আমলে কারাভোগ করেন দীর্ঘ ১১ বছর। জেলে থেকেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার ও নিগৃহীত হন। সরদার স্যার খ্যাত এ দার্শনিকের ‘প্লেটোর সংলাপ‘, ‘প্লেটোর রিপাবলিক’, ‘অ্যারিস্টলের পলিটিক্স’, ‘দর্শনকোষ’সহ কয়েকটি বই বাংলাদেশে দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পাঠ্য। কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা। ভাষা মতিন খ্যাত ভাষা আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ আবদুল মতিন। ৮৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৮ই অক্টোবর। সিরাজগঞ্জের কৃষক পরিবারের সন্তান উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বৃটিশ আর্মিতে যোগ দিয়ে কমিশন র‌্যাঙ্ক পান। যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় পড়ার সময় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কলাভবনের ছাত্রসভায় সভাপতিত্বকারী মতিন ছিলেন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। আজীবন বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ভাষা মতিন ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও রাজনীতি নিয়ে তিনি বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। অর্জন করেছেন একুশে পদক-২০০১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব ল’জসহ নানা পুরস্কার। মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করেন বরেণ্য এ ব্যক্তিত্ব। কবি, কৃতী শিক্ষাবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ৮৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১১ই নভেম্বর। শিক্ষাজীবনে অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী মনীষী রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ কয়েক যুগ অধ্যাপনা ও ভিসি’র দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯০-৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দূত হয়ে সফর করেছেন বিশ্বের অনেক দেশ। কবিতা রচনার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন বিস্তর। অর্জন করেছেন স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমিসহ অনেক পুরস্কার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১১ই জানুয়ারি। ১৯৪৯ ও ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এ সৈনিক একাধারে আইনজীবী, গবেষক ও অভিধানপ্রণেতা। শিক্ষাজীবনে অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী হাবিবুর রহমান ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও দীর্ঘ দুই যুগ হাইকোর্টের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি ও ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচারপতিদের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের। তিনি কবিতার পাশাপাশি আইন, ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ক অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। সাহিত্যকৃতীর স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী, একুশে পদক, হিউম্যান ডিগনিটি সোসাইটি থেকে সরোজিনী নাইডু পুরস্কার, স্পেশাল কনট্রিবিউশন টু হিউম্যান রাইটস পুরস্কার অর্জন করেন। জাতির মুরব্বী খ্যাত প্রখ্যাত সাংবাদিক, সম্পাদক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা। ৮৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন ৯ই এপ্রিল। ছয় দশকের বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবনে তিনি ইনসাফ, পাকিস্তান অবজারভার, বাংলাদেশ অবজারভার, সংবাদ, মর্নিং নিউজ, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় রিপোর্টার থেকে সম্পাদক নানা ভূমিকায় সাংবাদিকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি, সানডে টাইমসে সংবাদ পাঠাতেন রণাঙ্গন থেকে। এছাড়া পিআইবি, বাসস, ও বিটিভি’র শীর্ষপদসহ দায়িত্ব পালন করেছেন জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে। এমপি নির্বাচিত হয়েও রাজনীতি থেকে সরে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জাতির বিবেক হিসেবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের চারবার সভাপতি ও তিনবারের এ সাধারণ সম্পাদক সরকারের নির্মোহ সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু। টেলিভিশন টক-শোতে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন সরকারের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য এবিএম মূসা মৃত্যুর পর পাননি যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের অন্যতম প্রাণপুরুষ কাইয়ুম চৌধুরী। ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩০শে নভেম্বর। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে বক্তব্য দেয়ার সময় হঠাৎ করে অসুস্থ মঞ্চেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। তার শেষ কথা ছিল- ‘আমার একটি কথা ছিল।’ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে কিংবদন্তি কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীনের এ শিষ্য বাংলা সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। বর্ণিল পটভূমিতে মোটাদাগের নকশা তাঁর প্রধানতম অঙ্কনশৈলী। প্রচ্ছদ শিল্পকে তিনি নিয়ে গেছেন অন্যরকম এক উচ্চতায়। ভাষা আন্দোলনের এ সৈনিক কর্মজীবনে শিল্পচর্চার পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা। অর্জন করেছেন একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশের নানা সম্মানজনক পুরস্কার। দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুল আলম। ৭৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৬ই জুন। দীর্ঘ প্রায় ছয় দশকের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটস প্রেস অব পাকিস্তান, নিউ নেশন, সাপ্তাহিক ডায়ালগ, ইন্ডিপেনডেন্ট, বাসসের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি সাংবাদিকতা জগতে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে। নোয়াবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সংবাদপত্রের বিকাশ ও সাংবাদিকদের পেশাগত স্বার্থরক্ষায় তিনি পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সফলতার সঙ্গে লন্ডন হাইকমিশন ও ওয়াশিংটন দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব বিভাগের মহাপরিচালকসহ কূটনীতিক হিসেবে পালন করেছেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। ৭৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ৯ই ফেব্রুয়ারি। তিনি রচনা করেছেন ৩০টির মতো কাব্যগ্রন্থসহ অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রচলনে রেখেছেন পথিকৃতের ভূমিকা। কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার। জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার, বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এলকে সিদ্দিকী। ৭৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১লা আগস্ট। চট্টগ্রামের এক বনেদী পরিবারে জন্ম নেয়া এ রাজনীতিক জাতীয় নির্বাচনে সীতাকুণ্ড থেকে চারবার এমপি নির্বাচিত হয়ে জিয়াউর রহমানের সময় বিদ্যুৎ ও খালেদা জিয়ার সরকারে দুই মেয়াদের এ পানি সম্পদমন্ত্রী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি, ভারতের সঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের কো-চেয়ারম্যান, সংসদে বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও লেখক ফখরুজ্জামান চৌধুরী। ৭৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১২ই জুন। কর্মজীবনে বিটিভির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ষাটের দশকের অন্যতম এ সাহিত্যিক নানা মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন বিস্তর। অর্ধশতাধিকের বেশি গ্রন্থের এ রচয়িতা অর্জন করেছেন অগ্রণী ব্যাংক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। প্রবীণ সাংবাদিক, নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক এমপি এএন মাহফুজা খাতুন ওরফে বেবী মওদুদ। ৬৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২৫শে জুলাই। বেবী মওদুদের মৃত্যুতে হাসপাতালে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন- ‘তার মৃত্যুতে আমি আমার দীর্ঘদিনের একজন প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি’। প্রায় ৫ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি সংবাদ, বিবিসি, ইত্তেফাক, বাসস ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নানাপদে দায়িত্ব পালন করেন। একদা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বেবী মওদুদ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয় এবং নবম জাতীয় সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি সৃজনশীল ও মননশীল অর্ধশতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও প্রবীণ সাংবাদিক জগ্‌লুল আহ্‌মেদ চৌধূরী। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৯শে নভেম্বর। রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর সোনারগাঁও মোড়ে বাসচাপায় গুরুতর আহত হলে পথচারীরা তাকে নিয়ে যান পাশের একটি হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালে অবহেলাজনিত বিলম্বের কারণে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো আর সম্ভব হয়নি। বাসসের সাবেক এ প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৃত্যুকালে দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ৬৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১০ই নভেম্বর। ১৯৭৮ সালে কৃতী  এ শিক্ষার্থীর বয়স তখন মাত্র ২৬। ১৭-১৮ জন প্রতিযোগীর ৫৭টি নকশার মধ্যে তার নকশাটি চূড়ান্ত নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬’র শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ নির্দেশ করে এ স্থাপনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে তার অনন্য সাধারণ নকশায় নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলা এবং বাঙালি জাতির সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে চির ভাস্বর থাকবে। একুশে পদকে ভূষিত এ স্থপতি দীর্ঘদিন ধরেই লোকচক্ষুর আড়ালে বসবাস করতেন। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম। ৬০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২০শে ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার এ সন্তান মস্কো ও জার্মানির ম্যাক্সপ্ল্যাংক ইনস্টিটিউট থেকে দু’বার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে পাটের জিন নকশা ও ২০১৩ সালে দেশী পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ডাটাসফটের একদল গবেষক। বিশ্বে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১৭টি উদ্ভিদের জিন নকশার মধ্যে পাট, পেঁপে ও রাবার তিনটিই হয়েছে তাঁর হাতে। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও টকশো আলোচক প্রফেসর ড. পিয়াস করিম মৃত্যুবরণ করেন ১৩ই অক্টোবর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর তিনি দেশে ফিরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড সোশাল সায়েন্সেসে যোগ দেন। টেলিভিশনের টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক ও জাতীয় ইস্যুতে সাহসী বক্তব্য রেখে খুব দ্রুতই তিনি পরিণত হন এক দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কতিপয় প্রতিবাদী যুবকের অপপ্রচারে অনাকাঙ্ক্ষিত এক পরিস্থিতির জন্ম হয়। এছাড়া ভাষাসৈনিকদের মধ্যে- ১লা মার্চ ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক সাঈদ উদ্দীন আহমেদ, ৮ই মে ভাষাসৈনিক একেএম আজহারউদ্দিন, ৯ই মে ভাষাসৈনিক শফিয়ার রহমান, ১৩ই সেপ্টেম্বর ভাষাসৈনিক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাগরিক কমিটির সভাপতি আবদুস সামাদ, রাজনীতিকদের মধ্যে- ২০শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা ও টাঙ্গাইল-৮ আসনের সাবেক এমপি শওকত মোমেন শাহজাহান, ৫ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা ও কুষ্টিয়ার সাবেক এমপি খন্দকার রাশিদুজ্জামান দুদু, ১লা মার্চ বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহম্মাদ, ৯ই এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন, ৩০শে এপ্রিল জাতীয় পার্টির নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি নাসিম ওসমান, ৭ই জুন বিএনপি নেতা ও ময়মনসিংহের সাবেক এমপি আমানুল্লাহ চৌধুরী, ২০শে জুলাই রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আফতাবুন নাহার, ১৮ই আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ফেনীর সাবেক এমপি মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, ২রা সেপ্টেম্বর সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের ছোট ভাই সাবেক এমপি মোজাম্মেল হোসেন লালু, ১৯শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সরদার আমজাদ হোসেন, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে- ২১শে জানুয়ারি চলচ্চিত্রকার মহম্মদ হান্নান, ২৩শে জানুয়ারি সাহিত্যিক-সাংবাদিক জাকারিয়া শিরাজী, ১৯শে এপ্রিল ‘যারে যাবি যদি যা’ গানের শিল্পী বশির আহমেদ, ২৩শে মে কবি ও বিপ্রতীক সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকী, ২রা ডিসেম্বর শিক্ষাবিদ ও গবেষক তিতাশ চৌধুরী, ১২ই ডিসেম্বর সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক আহমাদ কাফিল, ১৮ই ডিসেম্বর কবি ও সাংবাদিক অরুনাভ সরকার, ৫ই সেপ্টেম্বর শাস্ত্রীয় ও লোকগানের শিল্পী রামকানাই দাশ, ২৭শে সেপ্টেম্বর নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের মা রত্নগর্ভা আয়েশা ফয়েজ, ৫ই নভেম্বর সংগীতজ্ঞ মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, ২২শে নভেম্বর ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার মনজুর হাসান মিন্টু, ৭ই ডিসেম্বর ঢাকাই সিনেমার শক্তিমান অভিনেতা খলিল, সাংবাদিকদের মধ্যে- ১৪ই অক্টোবর অবজারভারের ফটো সাংবাদিক আজিজুর রহীম পিউ ও ১৫ই অক্টোবর প্রবীণ সাংবাদিক ফওজুল করিম মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত দুই বিতর্কিত রাজনীতিক জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ও বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের প্রিজন সেলে মৃত্যুবরণ করেন।

No comments

Powered by Blogger.