দায়মুক্তির তকমা নিয়ে বছর পার by নিয়াজ মাহমুদ

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও উচ্ছপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করলেও তাদের অনেককে দায়মুক্তি দিয়েছে নিভৃতে। এসব কারণে ‘দায়মুক্ত কমিশন’ তকমা লেগেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী এ  সংস্থাটির গায়ে। পাশাপাশি এ সংস্থাটি বছরের মাঝামাঝি ও শেষদিকে  আরেক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা  ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি এবং টিআই’র তৈরি করা শিক্ষা খাত ও দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থার আরও অবনতি প্রকাশিত  রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে আলোচনায় ছিল। একই সঙ্গে বিদায়ী বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় আসে কমিশনের নাম। এতে আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ ৭ জনকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা এফআরটি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে; মামলার যথার্থতা না থাকা, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য, সাক্ষী না পাওয়ায় মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে দুদক। এ ছাড়া আট মাসে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়াদের মধ্যে আরও  রয়েছেন-  জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সাবেক এমপি এইচবি এম ইকবাল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, মন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, মোহাম্মদ নাসিম, ফিলিপাইনে বাংলাদেশের সাবেক রষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন নেসা, পেট্রোবাংলার জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) আইয়ুব খান চৌধুরী, সিআইডির সাবেক পুলিশ সুপার এম রফিকুল ইসলাম, রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক এম আবু তাহের, জাতীয় রাজস্ব  বোর্ডের সাবেক কর কমিশনার এমদাদুল হকসহ সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ, এমনকি রেলের নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধাও দুদকের করা পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান। রুহুল হক ছাড়া আরও যেসব সাবেক মন্ত্রী-এমপিকে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে দুদক অনুসন্ধান করে, তারা হলেন সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সরকারি দলের এমপি আসলামুল হক, এনামুল হক ও আবদুর রহমান বদি, বিএনপির দুই সাবেক এমপি শহীদ উদ্দীন  চৌধুরী ও মসিউর রহমান এবং জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আবদুল জব্বার। এদের মধ্যে আবদুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান ও আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী ও আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর আসলামুল হককে অভিযোগ  থেকে অব্যাহতি  দেয়া হয়েছে। দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে  রাজশাহীর এমপি এনামুল হককেও। এছাড়া  বহুল আলোচিত  সোনালী ব্যাংক  থেকে হলমার্কের ঋণ  কেলেঙ্কারির মূল ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ও দুদকের হলমার্ক মামলার আসামি সোনালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও  প্রদীপ কুমার দত্তের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নথিভুক্ত করে দুর্নীতির দায় থেকে তাকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে ঢাকডোল পিটিয়ে দুদক এসব অনুসন্ধান শুরু করলেও দায়মুক্তি দিয়েছে অনেকটা  নিভৃতে। এ অবস্থায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দুদকে দায়মুক্ত কমিশন বলে খেতাব দেন। এছাড়া অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দুদকের মামলা দায়েরের সংখ্যা ছিল অনেক কম। তবে দুদকের মামলায় শাস্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয় বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলেন ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন, হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভিরসহ দুর্নীতির মামলায় অনেকেই কারাগারে। তবে দুদকের মামলায় দুর্বল চার্জশিট ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শাস্তির সংখ্যা কমে গেছে  বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলার ফাইল ক্লোজড: পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলায় বিদায়ী বছর ৩রা সেপ্টেম্বর ৭ আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার যথার্থতা না থাকা, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য, সাক্ষী না পাওয়ায় এ মামলাটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নথিভুক্ত করেছে কমিশন। ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় এ মামলা করেছিল দুদক। এ মামলায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ  হোসেইন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইপিসির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা, কানাডীয় প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের ভাইস- প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। এছাড়া মামলার এজাহারে সন্দেহভাজনের তালিকায় ছিলেন সাবেক  যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল  হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান  চৌধুরী। পরে সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিক সত্যতা আর চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়। পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তি ছিল পত্রিকার তথ্য ও বিশ্বব্যাংকের আশ্বাস। বিশ্বব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা করা হলেও মামলা প্রমাণের জন্য দাতা সংস্থা ও কানাডা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হলো। দুদকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৭ আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত। তবে মামলাটি কানডার আদালতে চলবে বলে জানা গেছে। বিদয়ী বছর আট মাসে ৯০৪টি দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে ৮৭০ জনের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের হয়নি। এছাড়া, ৩০৭টি মামলায় ৭১৮ জন আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ায় তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে  চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদয়ী বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে যাচাই-বাছাই করে ৬৯১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে দুদক। এরমধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ১৪৬টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। আগস্ট মাসে কমিশন ১৮টি মামলা ও ১৭টি চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি  জানুয়ারি  থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৯৩টি মামলা, ৩৩৮টি চার্জশিট দাখিল ও ৩০৪টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এছাড়া আগস্ট মাসে ১০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে দুইটিতে সাজা ও আটটি মামলায় আসামিরা খালাস  পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতিতে অভিযুক্ত কমিশনের  মহাপরিচালক (ডিজি) কামরুল হাসানসহ ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করে কমিশন এতে অনুমোদন করলে ২২শে অক্টোবর দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করে তদন্ত শুরু করে। এছাড়া বছরের শেষদিকে ১৮ই ডিসেম্বর আলোচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের দুদকের মুখোমুখি হন। দুদক কার্যালয়ে তাকে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থার সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী। জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র ব্যবসয়ী মুসা ৪জন নারী দেহরক্ষীসহ প্রায় অর্ধশত দেহরক্ষী নিয়ে দুদকে হাজির হন। বিজনেস এশিয়ার একটি প্রতিবেদনকে ভিত্তি করে মুসা বিন শমসেরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত  নেয় কমিশন। সুইস ব্যাংকে ওই ব্যবসায়ীর সাত বিলিয়ন ডলার রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই’র) প্রচার করা দুর্নীতির ধারণা সূচকের কঠোর সমালোচনা করে দুদক এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন তারা কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। টিআইবিকে ঘরের  শত্রু বিভীষণ উল্লেখ  করে তিনি এ ধরনের শত্রুর কাছ  থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।  বিদয়ী বছর ৯ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে দুদক আয়োজিত আলোচনা সভায় সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন চুপ্পু  এসব কথা বলেন।

No comments

Powered by Blogger.