তিনি দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশে থাকছেন!

তিনি ছিলেন টিভি টকশোর অন্যতম পরিচিত মুখ। তাকে এখন দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ছিল তার পেশাগত স্থান। সেখানেও তিনি গরহাজির। ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে নিবন্ধ লেখার বিষয়ে প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছিলেন। সেখানেও তিনি নীরব। তিনি ড. তুহিন মালিক। চার শ’ বছরের ঢাকা চার মিনিটে ভাগ হওয়ার পরে ঢাকার দেয়ালে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নতুন পোস্টার পড়েছিল। সেই পোস্টারের নতুন মুখ ছিলেন তিনি। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তুহিন মালিক দেশদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানির মামলার আসামি হন। ঢাকার মহানগর হাকিম হাসিবুল হক আগামী ১৩ই জানুয়ারির মধ্যে তাকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু মনে করা হচ্ছে অতিসম্প্রতি নানামুখী চাপের মুখে তিনি সপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশে থাকতে পারেন বলেও ইঙ্গিত রয়েছে। তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তার তরফে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার পর শহরে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড-পোস্টার ইত্যাদির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলেন সম্ভাব্য তিন প্রার্থী। এদের মধ্যে হাজী মোহাম্মদ সেলিম ও সাঈদ খোকনের হাসিমাখা মুখের বিলবোর্ড-ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টারের মতোই চাঞ্চল্য তৈরি করেছিল তুহিন মালিকের পোস্টার আর দেয়াললিখন। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে হাজী সেলিম আর সাবেক মেয়র হানিফের ছেলে হিসেবে খোকনকে শহরবাসী ভালই চেনেন। কিন্তু অচেনা ছিলেন তুহিন মালিক। ঢাকায় বাঁচতে, ঢাকাকে বাঁচাতে- স্লোগান নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ড. তুহিন মালিক। সেটা ছিল এমন একটি সময়, যখন অনেকেই রাজনীতিতে নতুন মুখকে সম্ভাবনাময় মনে করতেন। তুহিন মালিক অনেকটা দ্রুত মিডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। তিনি উদারনৈতিক আলোচনাকেও গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু ক্রমেই তিনি সরকারি দলের কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি আচমকা খবরের শিরোনাম হন। ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
১০ই জুন রাজধানীর কাওরান বাজার এলাকায় তুহিন মালিকের গাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। এতে গাড়ির চালক আহত হন। ঘটনার সময় তুহিন মালিক ওই এলাকায় একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে ছিলেন। হামলাকারীরা তাকে না পেয়ে গালাগাল ও হত্যার হুমকি দেয়। হামলাকারীরা ভবিষ্যতে তুহিন মালিককে টকশোতে অংশ না নিতে গাড়িচালককে হুমকি দেয়।
ওই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক পিয়াস করিমকে টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশ না নিতে টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীরকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়।
এই প্রেক্ষাপটে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন, সাংবাদিক আফসান চৌধুরী, নূরুল কবীর, পিয়াস করিম, আসিফ নজরুল, সাংসদ গোলাম মাওলা রনি, ব্যাংকার মামুন রশীদ, শিক্ষাবিদ আমেনা মহসিন প্রমুখ ড. মালিকের পক্ষে বিবৃতি দেন।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী তৎপরতা মতপ্রকাশের অধিকার ও বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি চরম আঘাত। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারও মারাত্মক হুমকি। সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িতদের শনাক্ত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানান বিবৃতিদাতারা। তারা উল্লেখ করেন, টেলিভিশনের টকশোর মাধ্যমে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি ঘটানো হয়ে থাকে। হুমকি-ধমকি দিয়ে টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নেয়া থেকে তাদের বিরত রাখা যাবে না। এর পরে তার বনানীর বাসভবনে আরেক দফা হামলা চালানো হয়।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-সম্পাদক গোলাম রব্বানী ‘সংবিধান নিয়ে কটূক্তি’, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ ও ‘মানহানির’ অভিযোগে তুহিন মালিকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন। মহানগর হাকিম হাসিবুল হক প্রথম দুটি অভিযোগের শুনানি নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সেগুলো এজাহার হিসেবে গণ্য করতে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-কে নির্দেশ দেন আর মানহানির অভিযোগে গত ৯ই ডিসেম্বর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
উল্লেখ্য, তিন অভিযোগেই বলা হয়, গত ৩০শে নভেম্বর পূর্ব লন্ডনের ওয়াটার লিলি গার্ডেন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানিকর বক্তব্য দেন ড. তুহিন মালিক। তুহিন ওই আলোচনা সভায় কথিত মতে বলেন, ‘সংবিধানে সব মুজিবের কাহিনী ও এতে তার পরিবারের গানাবাজনা জুড়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো যে বাতিল করতে চেষ্টা করবে তার ফাঁসি হয়ে যাবে। সংবিধানে নাস্তিক্যবাদিতা ও ধর্মহীনতার বিষয় জুড়ে দেয়া হয়েছে। সংবিধানে যা জুড়ে দেয়া হয়েছে তা কিয়ামত পর্যন্ত কেউ সংশোধন করতে পারবে না। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ যা চান, মানুষ সেটা হয়তো বোঝে না। একমাত্র বিকল্প রয়ে গেছে সংবিধান বাতিল! কিসের জাতির পিতা, কিসের আদর্শ, কিসের চেতনা কিচ্ছুই থাকবে না, ইনশাআল্লাহ!’ তার ওই কথিত বক্তব্যে বাদীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানি হয়েছে এবং বক্তব্যটি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগ নেতা গোলাম রব্বানী।
উল্লেখ্য, ঢাকায় অবস্থানকালে ড. তুহিন মালিক একটি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে তিনি দাবি করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। তার বক্তব্য রেকর্ড রয়েছে। তিনি কি বলেছেন সেটা ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেটা বাজিয়ে শুনে নিলেই পরিষ্কার হবে যে, তিনি ওই ধরনের কোন কটাক্ষ বা মন্তব্য কোনটিই করেননি। তার কথায়, আমি লন্ডনের সভায় সংবিধান নিয়ে একাডেমিক আলোচনা করেছিলাম। আর সেটা আমি কয়েক বছর ধরে টকশো এবং বিভিন্ন মাধ্যমে করে আসছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর কথা বলে আসছি। এ কারণে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আমার বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.