ভাইয়ের কাছে শুনে শুনে চলে মাসুদার পড়া by আরিফুল হক

(বড় ভাই পাঠ্যবই থেকে পড়ছেন। শুনছে মাসুদা আক্তার। একই সঙ্গে রেকর্ড হচ্ছে মুঠোফোনে। দুর্বৃত্তের ছোড়া অ্যাসিডে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এভাবেই চলছে রংপুর শহরের বাবুখাঁ এলাকার মাসুদার লেখাপড়া l ছবি: মঈনুল ইসলাম) একটিমাত্র চৌচালা ঘরের সামনের আঙিনায় শীতের সকালে মুখোমুখি বসেছে দুই ভাইবোন। বড় ভাই মাজেদুর রহমান পাঠ্যবই থেকে শব্দ করে পড়ছেন। আর বোন মাসুদা আক্তার শুনছে সেই পাঠ। এভাবে শুনে শুনে চলছে মাসুদার পড়া। কারণ, মাসুদার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। জন্ম থেকেই দৃষ্টিশক্তিহীন নয় মাসুদা। কোনো দুর্ঘটনা বা রোগেও হারায়নি চোখের দৃষ্টি। দুর্বৃত্তের ছোড়া অ্যাসিড ওর দুটি চোখসহ শরীরের নানা অংশ ঝলসে দিয়েছে। তবে রংপুর শহরের নবম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীকে রুখতে পারেনি দৃষ্টিহীনতা। দৃঢ় মনোবল নিয়ে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেয়েটি। রংপুর শহরের সেনপাড়ায় সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি স্কুল ও কলেজে নবম শ্রেণিতে পড়ত মাসুদা। দিনটি ছিল ২০১২ সালের ১৩ আগস্ট। শহরের বাবু খাঁ এলাকায় তারই বাড়ির আঙিনায় পাশের বাড়ির বখাটে যুবক অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। এতে তার মুখ, পিঠ, হাতসহ শরীরের অনেক স্থান ঝলসে যায়। এরপর দীর্ঘদিন তার চিকিৎসা চলে। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
মাসুদা কিছু দেখতে পারে না। তার পরও এ বছর থেকে আবারও নতুন উদ্দীপনায় পড়াশোনা শুরু করেছে। বড় ভাই পাঠ করে ওকে সাহায্য করে। চাকরির কাজে বড় ভাইকে বাইরে যেতে হয়। এ জন্য মুঠোফোনে পড়ার বিষয়গুলো রেকর্ডিং করে দেন ভাই। সেটি শুনে শুনেও চলে তার পড়াশোনা। নতুন করে লেখাপড়া শুরু করার পর স্কুলের অনুমতি নিয়ে পরীক্ষার সময় মাসুদা বয়ান করে। তারই এক বন্ধু একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেন খাতায় লিখে থাকে। এভাবেই এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে মাসুদা।
মাসুদা বলছিল, ‘প্রকৃতির অপরূপ শোভা আর দেখতে পারি না। চোখ মেলে দেখতে পারি না সহপাঠী বন্ধুদের। পারি না আমার শখের খেলাধুলা করতে। এর পরও হাল ছাড়িনি। চোখের দৃষ্টি না থাকলেও জ্ঞান অর্জন করে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’
দৃঢ়প্রত্যয়ী মাসুদাকে স্কুল ও এলাকার সবাই মণি নামেই চেনে।
মাসুদার মা সুলেখা পারভিন জানান, বিয়ের বয়স না হতে পাশের বাড়ির আরিফ নামের এক যুবক বিয়ের প্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ির আঙিনায় এসে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। কোতোয়ালি থানা সূত্র জানায়, ওই সময়ের অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় বড় ভাই মাজেদুর রহমান বাদী হয়ে ঘটনার পরদিন ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় চারজনকে আসামি করা হয়। এঁদের মধ্যে একজন আসামি আরিফুল ইসলামকে (২০) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি এখনো কারাগারে। বাকি তিনজন জামিনে রয়েছেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মাসুদার বাবা মহুবার ইসলাম মারা যান। বড় দুই ভাই ও মাকে নিয়ে তাদের অভাব-অনটনের সংসার। এক ভাই ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। আরেক ভাই রংপুরের দরজির দোকানের কর্মচারী। মাসুদার দীর্ঘ সময় চিকিৎসা চলে। বর্তমানে সুস্থ হয়ে উঠেছে। চলাফেরাও করতে পারে। সুন্দরভাবে কথা বলে। মায়ের হাত ধরেই এখন তাকে স্কুলসহ সব জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়। মাসুদার মা সুলেখা পারভিন বলেন, ‘আমি নিজে পড়াশোনা করতে শিখিনি। একমাত্র মেয়ের আগ্রহ দেখে যত কষ্টই হোক আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
পড়াশোনার পাশাপাশি মাসুদা সৃজনশীল কাজে অংশ নিত। ভালো ভলিবল খেলোয়াড় ছিল। নৃত্যশিল্পী ছিল। সুন্দর আঁকাআঁকিও করত। আন্তস্কুল ভলিবল প্রতিযোগিতায় স্কুলের হয়ে খেলে সুনাম এনেছিল। ২০১২ ও ২০১১ সালে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ওর স্কুল। সরেজমিনে মাসুদাদের বাড়িতে গেলে তার হাতে পেনসিল স্কেচসহ আঁকাআঁকির কিছু খণ্ডচিত্র ও কৃিতত্বের সার্টিফিকেট দেখতে দেয়। মাসুদা বলে, ‘যত কষ্টই হোক। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। মানুষের মতো মানুষ হতে চাই।’ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এ ইচ্ছায় মাসুদার পাশে আছেন ওর স্কুলের শিক্ষকেরাও। সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি স্কুল ও কলেজের শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘মেয়েটি রাইটার দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। আমরা তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছি।’

No comments

Powered by Blogger.