খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নিন by এমএ খালেক

ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার সব প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ এবং অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানো হবে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা নিন; কিন্তু গিট্টুটা খোলেন। যাদের সহায়তা করলে খেলাপি ঋণ থেকে বেরোতে পারবেন তাদের সহায়ক হোন।
১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের এক বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয় বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনায় দৃশ্যত আপত্তিকর কিছু নেই। কিন্তু অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, এতে যেনতেন প্রকারে খেলাপি ঋণ কমানোর প্রবণতা বাড়বে। উল্লেখ্য, এ বছর গোড়ার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের নির্দেশ প্রদান করে। এ নির্দেশনার পেছনে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, ২০১৩ সালে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সহিংসতা বিরাজ করে তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। তাই তাদের ঋণ পরিশোধে সক্ষম করে তোলার উদ্দেশে কোনো ধরনের ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়। গত জুন পর্যন্ত এ সুযোগ বহাল ছিল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ করা হয়। ঋণ হিসাব অবলোপন ও পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেখানো গেলেও এতে ব্যাংকিং সেক্টরের কোনো লাভ হয়নি। বরং পুনঃতফসিলিকরণকৃত ঋণ হিসাবধারীরা যথাসময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ব্যাংকিং সেক্টর মারাÍকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে যেসব উদ্যোক্তা বা ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ হিসাব ক্লিন দেখাতে সমর্থ হয়েছেন তারা অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। নতুন ঋণের কিস্তিও তারা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করছেন না। উল্লেখ্য, প্রচলিত ব্যাংকিং আইনে একজন ঋণখেলাপি অন্য কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পান না, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আগের ব্যাংকের ঋণ হিসাব নিয়মিত করেন। ব্যাংক হিসাব নিয়মিত করার দুটি পদ্ধতি আছে। প্রথমত, তাকে লেনদেনকৃত ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও তিনি নতুন করে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন, যদি আগের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করে নিতে পারেন। খেলাপি ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও নিজেকে ক্লিন দেখানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করে নেয়া। সাধারণত প্রভাবশালী উদ্যোক্তারাই ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুবিধা ভোগ করতে পারেন। এছাড়া অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেও অনেকে এ সুবিধা পেয়ে থাকেন।
ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ এবং ঋণ হিসাব অবলোপন- এ দুটি শব্দ সম্পর্কে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। তাই এ ব্যাপারে সামান্য কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। একজন উদ্যোক্তা বা ব্যক্তি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণকালে যে চুক্তি করে তাতে এ ধরনের একটি শর্ত থাকে যে, কতদিন পরপর তাকে ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে হবে। কোনো কারণে ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তাকে ঋণখেলাপি বলা হয়। আসলে ঋণখেলাপি বলতে আমরা এমন একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝি, যিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন। ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ বলতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা পুনঃনির্ধারণ করাকেই বোঝায়। ঋণ হিসাব পুনঃনির্ধারণ বলতে শুধু যে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো বোঝায় তা নয়, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কমানোকেও পুনঃতফসিলিকরণ বলা যেতে পারে। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ বলতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোকেই বোঝানো হয়।
ঋণ হিসাব অবলোপনকে এমন একটি অবস্থার নির্দেশক মনে হতে পারে, যেখানে ব্যাংক তার ঋণের দাবি ত্যাগ করেছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়, ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ হচ্ছে খেলাপি ঋণকে ব্যাংকের মূল লেজারে প্রদর্শন না করে অন্যত্র স্থানান্তর করে রাখা। কোনো খেলাপি ঋণ হিসাব ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং কিস্তি আদায়ের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে- এমন ঋণ হিসাব কিছু শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে অবলোপন করা যেতে পারে। ব্যাংক ধরে নেয় যে, সংশ্লিষ্ট হিসাব থেকে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে এমন অবস্থাতেও আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি লাভ বা মুনাফা হিসেবে গণ্য হয়। যেহেতু ব্যাংক সেই ঋণের কিস্তি আদায়ের আশা পরিত্যাগ করেছিল। ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ তার মূল লেজারে প্রদর্শন করে না। কিন্তু পাওনা দাবি কখনোই ত্যাগ করে না।
এ বছর গোড়ার দিকে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ করা ছাড়াই খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের জন্য শিডিউল ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেয়। তখন অনেকেই বলেছিলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিবর্তে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হলে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানো গেলেও এতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। তাদের সেই আশংকাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়ার ফলে রাতারাতি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যায়, যদিও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায়ে সক্ষম হয়নি। ডাউন পেমেন্ট ছাড়া খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়ার ফলে ব্যাংকিং সেক্টর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ঋণখেলাপির কারণে যেসব উদ্যোক্তা অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণে সমর্থ হচ্ছিল না, তারা এ সুযোগে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে। যেহেতু ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের কারণে তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়নি। ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই যারা খেলাপি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ পায়, তাদের বেশিরভাগই মেয়াদান্তে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। গত সেপ্টেম্বর কোয়ার্টার শেষে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এটা ছাড়কৃত মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত জুনে এটা ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা। জুনের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো মোট ৩১ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকার ঋণ হিসাব অবলোপন করেছে। অর্থাৎ অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৮ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ এযাবৎকালের মধ্যে সর্বাধিক।
খেলাপি ঋণ আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। কোনোভাবেই এ সমস্যা দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা যায় না। যে কোনো মূল্যেই হোক এর নিরসন করতে হবে। কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর নামে আবারও যদি ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ ও অবলোপনকে উৎসাহিত করা হয় সেটা আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনতে না পারলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমবে না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের ‘কস্ট অব ফান্ড’ বেড়ে যায়। তারা বিনিয়োগযোগ্য অর্থের জন্য উচ্চসুদ হারে আমানত সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়।
আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অযৌক্তিক আচরণও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন, ব্যাংক তাদের তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা প্রদান করে না। কিন্তু যারা বছরের পর বছর ঋণের কিস্তি আটকে রাখে, তাদের সুদ মওকুফ সুুবিধাসহ নানা প্রণোদনামূলক সুবিধা দিয়ে থাকে। এতে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীরা নিরুৎসাহিত হন। ঋণখেলাপিদের মধ্যে আবার দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী আছে। একটি শ্রেণী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা প্রতিকূলতার কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারে না। এরাই হচ্ছেন প্রকৃত ঋণখেলাপি। এদের ঋণ পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলার জন্য নতুন করে ঋণ প্রদানসহ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা যেতে পারে। আর এক শ্রেণী আছে যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে না। এটা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া উচিত নয়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কঠোর আইনি ব্যবস্থার আওতায় আনা যেতে পারে। এছাড়া তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা যেতে পারে। কিছু উদ্যোক্তা বা ঋণগ্রহীতা আছেন, যারা ব্যাংক ঋণ আত্মসাৎ করার জন্যই ঋণ গ্রহণ করেন। এদের কাছে ঋণের সুদের হার কোনো ফ্যাক্টর নয়। কারণ তারা জানেন, এ ঋণের অর্থ তিনি কোনোদিনই ফেরত দেবেন না। এদের ঋণ প্রদানকালেই প্রতিহত করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে একটি দেশের অর্থনীতি ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। তাই যেভাবেই হোক ব্যাংক ব্যবস্থাকে সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে।
এমএ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.