পিতাকে দেয়া কথা রাখা হলো না তাপসের

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানার নিধিপুর গ্রাম। মাটির রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলেই বাবুল সরকারের ঘর। একেবারেই পাড়াগাঁ। দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস। পড়ালেখা কি তা জানেন না এই খেটে খাওয়া মানুষটি। তাই ইচ্ছা ছিল নিজের অযত্নে বেড়ে ওঠা সন্তানদের অন্তত একজনকে ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে পড়ছে- সব সময় গর্ব করবেন। কিন্তু তার সেই আশা কেড়ে নিলো ছাত্র রাজনীতির কালো থাবা। কে জানতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অকালেই ঝরে যাবে তার শেষ সম্বল পুত্র তাপস সরকারের প্রাণ! পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট সারাজীবন তাকে যন্ত্রণা দেবে।  গত ১৪ই ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মেধাবী ছাত্র তাপস। পরিবারে এখনও চলছে শোকের মাতম। রোজ রাতে ছেলেকে ঘুমের ঘোরে দেখছেন পিতা বাবুল। ভাইকে হারিয়ে নির্বাক আশিস্‌ সরকার। প্রতিদিনই সিলেটের এই পরিবারে চলছে আর্তনাদ। কান্না। আহাজারি। চট্টগ্রামেও প্রিয় বন্ধু ও সহপাঠীর জন্য চলছে শোকগাথা।  পরিবারটির বর্তমান অবস্থা জানতে এই বিষয়ে মানবজমিন-এর সঙ্গে কথা বলেন নিহত তাপসের পিতা, ভাইসহ অন্য সদস্যরা। তারা জানান, এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের কেউই। আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল না থাকায় ছোটবেলা থেকেই খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে তাকে।  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে তাপস গ্রামে গ্রামে টিউশনি করতেন। পিতার পক্ষে কখনওই সম্ভব ছিল না ছেলের জন্য শিক্ষার উপকরণ কিনে দেয়ার। ১৯৯২ সালে জন্ম হয় তাপসের। অন্যের বাড়িতে টিউশনি করে পেতেন ১২০০ টাকা।  সুনামগঞ্জের দিরাই থানার নয়াগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে।  ছেলের এমন সাফল্য দেখে পিতা বাবুল সরকার তখনি বুঝেছিলেন তার ঘরে জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারে এই ছেলেটি।  এই বিষয়ে ফোনে বাবুল সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, এখন আর এসব বলে কি হবে। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। ছেলেটাকে তো আর পাবো না। ওকে তো মেরে ফেললো সন্ত্রাসীরা। ছেলেটা গুলি খেয়ে নিশ্চয় ছটফট করেছে। আমি এর বিচার চাই। ছেলে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত চাই সরকারের কাছে।  তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালে  নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে ছেলেটা জিপিএ-৫ পায়। এরপর চিটাগাং ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। প্রায়ই আমারে বলতো ‘বাপ, চিন্তা করিস না। দিন ফিরে যাবে। একটু পাস করতে দে। ভাল চাকরি হবে। তখন এসব টাকার কষ্ট আর অভাব থাকবে না।’ তার  ভাইদেরও বলতো এসব কথা।  পারিবারিক অবস্থা তেমন ভাল না হওয়ায় প্রায়ই রোজ রাতে বন্ধুদের সঙ্গে এসব কষ্টের কথা ভাগাভাগি করতেন নিহত তাপস। তার বন্ধুদের বলতেন, আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। বাড়িটা নদী খেয়ে ফেলেছে। বাবা, ভাই সবাই খুব কষ্ট করছে। এই তো কয়দিন আগে জমি কিনে কোনভাবে একটা ঘর তুলেছে। সেই ঘরের টাকাটা এখনও দেয়া হয়নি। এই অবস্থায় সামনে পরীক্ষা। ফরম ফিলআপের টাকা কোথা থেকে ব্যবস্থা হবে তা জানি না।
তাপসের পারিবারিক সূত্র জানায়, বাবুল সরকারের ৫ সন্তান। এক ছেলে দিনমজুর, আরেকজন  দোকানে কাজ করেন। তাপস ভাইদের মধ্যে তৃতীয়। সে-ই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখেছে। বাকি দুই ভাই এখনও ছোট। স্কুল ও কলেজে পড়ছে।  ২০১৩ সালে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তাপস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রিয় সাবজেক্ট ছিল সংস্কৃতি।  গতকাল তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে সেখানে কথা হয় বন্ধুদের সঙ্গে। পার্থ বণিক নামের এক ছাত্র বলেন, তাপস আর আমি একসঙ্গে ছিলাম। সম্প্রতি সে হঠাৎ করে হলে উঠে যায়। কারণ হিসেবে জানায়, পারিবারিক অবস্থা ভাল নয়। তাই টাকা দিয়ে মেসে থাকার মতো সামর্থ্য নেই তার। জবাবে পার্থ তাকে ছাত্র রাজনীতির কথা মনে করিয়ে দিলে তাপস সব কিছু থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্‌ আমানত হলের ২৩৩ নম্বর কক্ষ। বর্তমানে এই ঘটনার পর হল কর্তৃপক্ষ রুমটি সিলগালা করে রেখেছেন। ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল তার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ১৪ই ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে হঠাৎ মাঝখানে পড়ে যায় তাপস।  এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের একটি অংশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে সে ঘটনাস্থলেই ‘মাগো’ বলে চিৎকার দেয়। এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে তার মৃত্যু হয়। তাপস যখনি ছুটি পেতেন তখনি গ্রামে চলে যেতেন। সেখানে পিতার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। তাপসের বড় ভাই আশিস্‌ সরকার বলেন, আমরা চাই না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে আর কোন ছেলেকে এভাবে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। আমার ভাই যে যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে সেই একই যন্ত্রণা আমরা এখন বেঁচে থাকতে পাচ্ছি। ভাই হারানোর কষ্ট আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে। ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, তাপসের মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রলীগের দু’টি পক্ষ একে অপরকে দায়ী করছে। সর্বশেষ এই ঘটনায় ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ৫ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপিং ক্যাম্পাসের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করেছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র প্রশাসনিক দুর্বলতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে ছাত্রলীগ এভাবেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একটি পক্ষ ভিসি’র সহযোগিতায় ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কর্মকা- চালিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর সিরাজদৌলা মানবজমিনকে বলেন, ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যেন  কোন ছাত্রের প্রাণ না যায় সেদিকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.