ঘুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় মন্ত্রীরা!

সরকারি দফতরের অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতি রোধে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও আসছে না তেমন কোনো কার্যকরী ফল। দুর্নীতিবাজদের চক্র থেকে মুক্ত হচ্ছে না দফতরগুলো। আবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একরকম অসহায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। তাদের এই অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ্যে বলতেও দ্বিধাবোধ করছেন না কোনো কোনো মন্ত্রী।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত ভয়াবহ অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতির বেড়াজালে আক্রান্ত বলে উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের টিআইর দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা আরও বেড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ এগিয়ে ১৪তম। আগের বছর ছিল ১৬তম অবস্থানে। টিআইর দুর্নীতি সূচকে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫, যা ছিল ২৭। টিআইর এ প্রতিবেদন সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যান করা হলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপের কথা স্বীকার করেছেন সরকারেরই কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী। তাদের মতে, সেবা খাত থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগেও হয় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। আছে রাজনৈতিক চাপও।
৪০ বছর আগে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে ঘুষ দিতে হয়েছিল উল্লেখ করে গত ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সেসময় আমাকেও অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষ নেয়া বা দেয়াকে অবৈধ মনে করি না। যেটা কোনো কাজের গতি আনে, আমি মনে করি সেটা অবৈধ নয়। উন্নত দেশগুলোতে এটাকে বৈধ করে দেয়া হয়েছে, তবে ভিন্ন নামে। উন্নত বিশ্বে এটাকে স্পিড মানি বলা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দলের অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ডেসকো, ওয়াসাসহ সেবামূলক পাঁচ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অবাধে দুর্নীতি করেন অধস্তনরা। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ, বিআরটিএ, জাতীয় গৃহায়ন কতৃর্পক্ষ, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও রাজউকসহ রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সেবা সংস্থা সম্পর্কে দুদকের কয়েকটি দলের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তেও একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে।
দুদকের এসব তথ্যের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য। গত ২৯ নভেম্বর ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত জনস্বার্থে গৃহ নির্মাণ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি বলেন, রাজউকের কর্মকাণ্ডেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। জমি, প্লট, ফ্ল্যাট নিয়েও অনেক কথা শোনা যায়। অবস্থা দেখে মনে হয়, রাজউকের কোনো কাজ নেই। তারা শুধু মাল (টাকা) কামাতে ব্যস্ত।
টিআইবির একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সরকারি হাসপাতাল, সাবরেজিস্ট্রার অফিস, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ কার্যালয়, আয়কর অফিস, তহসিল অফিস, পৌরসভা, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, দেশের সব থানা, কারাগার, বিআরটিএ, বিআরটিসি, রেলস্টেশন, বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ, শিক্ষা বোর্ড, সরকারি পরীক্ষাগারসহ সেবামূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা কৌশলে ঘুষ, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ ও সম্পদ লোপাটে জড়িয়ে পড়ছেন।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দেয়া এক বক্তব্যে মিলেছে এসব অভিযোগের সত্যতা। গত ২৯ নভেম্বর যুগান্তর-যমুনা টিভি ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) যৌথ ব্যবস্থাপনায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্ব কার শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিআরটিএর ঘুষ-দুর্নীতি প্রসঙ্গে সরকারের এ মন্ত্রী বলেন, শর্ষের মধ্যেই এত ভূত! সমাধান করা খুব কঠিন। কি করব বলুন, যেখানে যাকেই দিই, সেই শুরু করে দেয়। এ জন্য আজ একজনকে এখানে দিই, অন্যজনকে সেখানে দিই, এভাবে চলছে। বদলি করতে করতে, আর কত বদলি করব, বলুন। ওখানে বদলি মানেই বাণিজ্য, সরাতেও বাণিজ্য। সেতুমন্ত্রী আরও বলেছেন, সবাই চায়, হয় মিরপুরে, নয়তো ফকিরাপুলে বা চট্টগ্রামে বদলি। কারণ ওখানে তো সোনার খনি। কী করব বলুন। যাকেই সেখানে দিই, সেই শুরু (ঘুষ) করে দেয়। আর একজন যদি বদলির জন্য এক লাখ টাকা খরচ করে, তবে সে ২০ লাখ টাকা উঠাতে চায়। এটা আগে শতভাগ ছিল। ৫০ ভাগ কমেছে, এখনও ৫০ ভাগ রয়েছে।
ঘুষ-কালচার ও দুর্নীতির পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দফতরে চলছে অযাচিত রাজনৈতিক চাপ। এ চাপের কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গত ২৯ নভেম্বর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) কলেজ নিয়ে আমার ভাবনা শীর্ষক এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজনৈতিক চাপের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মন্ত্রী হওয়ার আগে ভেবেছিলাম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় কলেজে উপাচার্য বা অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি হবেন না। অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা গবেষণার প্রতি আগ্রহী থাকবেন। তাদের হাতে-পায়ে ধরে উপাচার্য বা অধ্যক্ষ হতে রাজি করাতে হবে। কিন্তু এখন দেখি, এসব বড় বড় পদের জন্য আমার পায়ে ধরে থাকেন অনেকে। বিভিন্ন নেতাকর্মী, এমপি, মন্ত্রী চাপ সৃষ্টি করে অমুককে অধ্যক্ষ বানাতেই হবে।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সার্বিকভাবে দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যও তা প্রমাণ করে। তার পরও সরকারের নীতিনির্ধারকদের অন্তরে এক, মুখে আরেক। নিজেদের দোষ স্বীকার করার কালচার এখনও চালু হয়নি দেশে।

No comments

Powered by Blogger.