বেঁচে থাক ঢাকা

ভেঙ্গে ফেলা ঢাকা শহরের বৃত্তান্ত কী? কোনো সুখবর আছে কি তার? না, নেই। এ আমার সেই ঢাকা। সেই পুরনো ঢাকা। আরো আরো কষ্ট, যন্ত্রণা, বিড়ম্বনার প্রায় অকার্যকর এক ঢাকা। কোলকাতা শহর নিয়ে ১৯৯৯ সালে লেখা The City Of Joy বইয়ে লেখক ডমিনিক ল্যাপিয়ার কোলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন, Here there is no more hope ...... all that is left is anger.  A  আজকের ঢাকাও তাই। এখানে আর কোনো আশা নেই। আছে দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ। বসবাস অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। চারশ’ বছরের ঐতিহ্যম-িত তিলোত্তমা এই শহরে তবু মানুষ আসছে বানের পানির মতো প্রতিদিন। গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। ফুরিয়ে যাচ্ছে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। বলা হয় “ঢাকায় টাকা ওড়ে”। সেই টাকা ধরার জন্য চলছে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ঢাকা যেন জীবন ও জীবিকা নির্বাহের অনিঃশেষ রতœভা-ার। অন্য কোথাও যার কিছুই করার নেই, তারই অনিবার্য গন্তব্য এই ঢাকা শহর। যার কিছু করার আছে সেও এই ঢাকামুখী। চাকরির জন্য ঢাকা, ব্যবসার জন্য ঢাকা, পড়াশুনার জন্য ঢাকা, চিকিৎসার জন্য ঢাকা, ভিক্ষার জন্যও ঢাকা। কিন্তু কী আছে ঢাকার? বুড়িগঙ্গার আঁধার-কালো পানির মতোই সে আজ বিবর্ণ। দিতে দিতে সে আজ নি:স্ব। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
নাগরিক সেবা বাড়ানোর উদ্দেশে ঢাকা কে দ্বিখ-িত করা হলো। সেবা বৃদ্ধি পেল কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হলেও মশার বংশবৃদ্ধি চলছে অবিরাম। বংশবৃদ্ধি রোধে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। কিছু এলাকার রাস্তা-ঘাটের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই অবর্ণনীয়। দেখে বিশ্বাস করা কঠিন এগুলো আসলেই কোনো সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা। অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে সিটি কার্যক্রম চলছে বছরের পর বছর। তিন মাসের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলতে পারে না যে দেশে, সেই দেশে বছরের পর বছর দুই কোটি মানুষের সিটি কপোরেশন চলছে অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে। এদের স্বাভাবিকভাবেই কোনো জবাবদিহিতা নেই, দায়ববদ্ধতা নেই, নেই কোনো পরিকল্পিত উন্নয়ন ভাবনা।
ঢাকায় থাকার এখন বড় বিড়ম্বনার নাম যানজট। নগরবাসীর কাছে যানজটের চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী,  প্রেসিডেন্টসহ রাষ্ট্রীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন গণ্যমান্য ছাড়া সবাই এর ভুক্তভোগী। গরিব এই দেশটির কতো কর্মঘণ্টা প্রতিদিন দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়! কর্মব্যস্ত ঢাকা মাঝেমধ্যেই হয়ে যায় স্টিল ক্যামেরার স্থিরচিত্র। অফিসে পৌঁছার নির্দিষ্ট সময় পাড় হয়ে যায়, ক্লাশের সময় অতিক্রান্ত হয়, চাকরির ইন্টারভিউ’র সময় চলে যায়, নির্দিষ্ট সময়ে কারো কাছে পৌঁছার ওয়াদা ভঙ্গ হয়, কোথাও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে দমকল বাহিনী পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুড়ে ছাঁই হয়ে যায় সব, অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছার আগে মুমূর্ষু রোগী শেষ ঠিকানায় চলে যানÑ এসবই ঢাকার নিত্যদিনের চিত্র। অফিস শেষে মতিঝিল থেকে মিরপুর আসতে তিন ঘণ্টা লাগার ঘটনা এখন প্রায় নৈমিত্তিক। দেশে মোট প্রাইভেট কারের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। প্রতিদিন দেশে দুইশ’র উপরে নতুন প্রাইভেট কার নামছে, যার অধিকাংশই ঢাকার বুকে। রাস্তা নেই, পার্কিং এর জায়গা নেই। তবু আসছে নতুন নতুন গাড়ি। শহরের বিশেষ করে ইরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে প্রায় প্রতিজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে প্রাইভেট কার। এই প্রাইভেট কার একবার তাকে বাসা থেকে নিয়ে আসে। স্কুল শেষে আবার তাকে বাসায় নিয়ে যায়। ফলে স্কুল শুরু এবং শেষের সময় সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজটের। অথচ এর একটি সহজ সমাধান আছে। দরকার শুধু সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা। সেখানে বলা হবে, কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে প্রাইভেট কারে স্কুলে পাঠাতে পারবেন না। স্কুলের সামনের রাস্তায় কোনো প্রাইভেট কার পার্ক করা যাবে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে স্কুল বাস সার্ভিস চালু করবে। শিক্ষার্থী আনা নেওয়ার জন্য তারা একটি মাসিক চার্জ ধার্য করবে। এতে করে বিশ জন শিক্ষার্থীর জন্য বিশটি প্রাইভেট কারের কাজ একটি বাস দিয়েই সম্পন্ন করা যাবে। রাস্তার উপর গাড়ির চাপ কমবে। যানজট কমবে। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তাদের অভিবাবকেরও বাসে বসার ব্যবস্থা থাকবে। আমাদের ধারণা, যানজট নিরসনে এটি একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। পদক্ষেপটি নেওয়ার ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা তাদের বাচ্চাদের লিমুজিন, মার্সিডিজ, ল্যান্ড ক্রুসারের পরিবর্তে বাস গাড়িতে দিতে আগ্রহী হবেন না। অথচ এটি করা গেলে যানজট নিরসনের পাশাপাশি গ্যাসেরও বিপুল সাশ্রয় হতো।
যানজট নিরসনে বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাটি হতে পারে বেশ কার্যকর। ঢাকাকে কেন্দ্র করে সবকিছু পরিচালিত হয় বলেই সবাই ঢাকামুখী। মুখ অন্যদিকে ফেরাতে হবে। রপ্তানি আয়ের ৬৫% এর উৎস গার্মেন্টস শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার সবার আগে। সব গার্মেন্টস কারখানা ঢাকায়। ঢাকায় একটি নতুন গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে নতুন কয়েকশ’ লোকের অবধারিত বসবাস। এই তৈরী পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এটিকে নিয়ে দরকার বিস্তর পরিকল্পনা। গড়ে তোলা যেতে পারে একটি আলাদা ‘তৈরী পোশাক শিল্প এলাকা’। এবং অবশ্যই সেটি ঢাকার বাইরে। একইভাবে ট্যানারি শিল্পকেও ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সিটি কর্পেরেশনগুলোর যথাযথ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে মানুষ হাতের কাছেই সবকিছু পেলে আর ঢাকায় আসবে কেন? এরপরও যাদের কাজ ঢাকায়, তাদের জন্য ঢাকায় আসা সহজ করতে হবে। যেন বাড়িতে থেকেই ঢাকায় এসে অফিস করা যায়। এখন গাড়িতে মিরপুর থেকে মতিঝিল যেতে যত সময লাগে, তার চেয়েও কম সময়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকায় বসবাসের আরেক বিড়ম্বনার নাম পরিবেশ বিপর্যয়। বুড়িগঙ্গার পানি দেখে কেউ ভুল করেও বলতে পারবে না- পানির অপর নাম জীবন। এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে না পারলে ঢাকা বাঁচবে না। পয়:নিষ্কাষণ ব্যবস্থা, বর্জ্য অপসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধুনিক কর্মপন্থা ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা শহরে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার এখনো নিষিদ্ধ করা যায়নি। হাজার হাজার গাড়ি আর তার কোটি কোটি হর্ন, যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়, নগরবাসীকে বিরক্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে যায়। এই হাইড্রোলিক হর্ন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাথাব্যাথা, স্নায়ুবিক সমস্যাসহ নানা রোগের জন্য দায়ি। ঢাকা শহরের বাতাসে সিসার অভাব নেই। মানুষের শব্দ ধারণের সহনীয় মাত্রা ৪৫ ডেসিবল হলেও ঢাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা ১০০ ডেসিবলেরও বেশি। এটি নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেই।
এই হলো প্রাণের ঢাকা। অবাক এক শহর। সম্ভাবনার শহর। শঙ্কার শহর। স্বপ্নের শহর। স্বপ্ন ভঙ্গের শহর। তবু এ এক প্রাণের শহর। আসুন, এ শহরকে বাঁচাই।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.