জন্মসনদ চান যুদ্ধশিশু মনোয়ারা by উৎপল রায়

বাংলাদেশই আমার দেশ। এ দেশই আমার ঠিকানা। আমি তো এ দেশেরই কোন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি। তাই এ দেশটা তো আমারও। আবেগমথিত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন একাত্তরের যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্ক। শেকড়ের সন্ধানে এই বিজয়ের মাসে ছুটে এসেছেন তিনি বাংলাদেশে। কে তার মা এ তথ্য জানা নেই তার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কানাডার একটি শিশুভিত্তিক সংগঠন তাকে নিয়ে যায় সেখানে। যুদ্ধশিশু হিসেবে অন্যের আশ্রয়ে বড় হয়েছেন সুদূর কানাডায়। শুধু জানেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশেরই কোন এক পাকিস্তানি সেনাক্যাম্প থেকে তার মাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই মায়ের গর্ভ থেকেই তার জন্ম। বাংলাদেশের সমান বয়সী মনোয়ারা ক্লার্ক বাংলাদেশে এসে তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছেন প্রতিনিয়ত। খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার জন্মদাত্রী  মা ও স্বজনদের। কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে এদের খুঁজে বের করার কাজটি যে কঠিন এটি তার জানা। কিন্তু হাল ছাড়ছেন না তিনি। তার বিশ্বাস নিজের শেকড়ের সন্ধান তিনি পেয়ে যাবেন। প্রাচুর্য থাকলেও প্রতিনিয়ত কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করেন তিনি। লাল সবুজের পতাকার কথা মনে হলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে তার। যদিও পাশ্চাত্য সভ্যতায় বেড়ে ওঠা তবুও মনের কোণে লালন করেন বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা। গভীর এ মমত্ববোধ থেকেই গত ৩০শে নভেম্বর এদেশে আসা। মনোয়ারা ভাবতে ভালবাসেন এই দেশ তার। কিন্তু পাশাপাশি প্রশ্নও তার কেন এই দেশ তাকে থাকতে দিলো না? মনোয়ারা জানান, বুঝতে শেখার পরই তিনি তার পিঠের পিছনের দিকে লম্বা একটা দাগ দেখতে পান। তিনি তার পালিত পিতা মি. ক্লার্ক ও  মা হেনরি ক্লার্কের কাছে জানতে পারেন, নির্যাতনের পর পাক বাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে তার মায়ের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে। আঘাতপ্রাপ্ত হয় গর্ভের শিশুটিও। পরে বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থায় জন্ম তার। এরপরই কানাডায় গমন। পালিত পরিবারে মনোয়ারা বেগমের পরিবর্তে মনোয়ারা ক্লার্ক নাম ধারণ করে বড় হতে থাকেন তিনি। নিজের পিঠের দাগ থেকে অনুমান করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের ভয়াবহতা। সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শনের সময় কথা হয় মনোয়ারার সঙ্গে। তিনি জানান, একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হ্যালকি ফেরি নামে একজন কানাডিয়ান নাগরিকের সহায়তায় তার জন্ম হয় পুরান ঢাকার মাদার তেরেসা হোমসে। পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়ে জন্মগ্রহণ করা অনেক শিশুর ঠাঁই হয়েছিল এখানে। পরে একটি শিশু সংগঠন সেখান থেকে অনেক শিশুর সঙ্গে মনোয়ারাকেও নিয়ে যায় কানাডায়। সেখানে মিস্টার ক্লার্ক ও হেনরি ক্লার্ক নামের দম্পতির সংসারে মনোয়ারার ঠাঁই হয় দত্তক শিশু হিসেবে। ক্রমেই বড় হতে থাকেন তিনি। কিন্তু ছোটবেলায়ই তার গায়ের রঙ তাকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। দত্তক নেয়া বাবা-মার কাছে জানতে পারেন তিনি “যুদ্ধশিশু”। তার কোন আত্মপরিচয় নেই। তখন থেকেই মনোয়ারা নিজ পরিচয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মনোয়ারা জানান, ক্লার্ক ও হেনরি  ক্লার্কের সংসারে তের বছর পর্যন্ত ছিলেন তিনি। পরে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তাদের ছেড়ে চলে যান। একপর্যায়ে তাকে কাছে টেনে নেন মার্গারেট নামের একজন মহিলা। তাকেই মা বলে সম্বোধন করতে থাকেন মনোয়ারা। তিনি বলেন, উনার আশ্রয়েই আমি বড় হয়েছি। উনি আমাকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছেন। পড়ালেখা করিয়েছেন। উনি একজন ভাল ও আদর্শ মা হিসেবে আমাকে আগলে রেখেছেন। মনোয়ারা জানান, কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  গ্রাজুয়েশন করে তিনি সেখানকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। প্রায় ১২ বছর আগে ফিনল্যান্ডের এক যুবকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। প্রথম সন্তান জুলিয়েটের জন্মের পরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার। এরপর থেকে জুলিয়েট মাসের পনের দিন মনোয়ারার কাছে, বাকি পনের দিন থাকে তার বাবার কাছে। জুলিয়েটের বয়স এখন দশ এবং সে ভ্যাঙ্কুভারের স্থানীয় একটি শিশু স্কুলে পড়ছে। মনোয়ারার সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, স্কুলে পড়াকালেই বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতেন তিনি। এক পর্যায়ে ওখানে অভিবাসী হিসেবে অবস্থান করা অনেক বাঙালির সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠলে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন মনোয়ারা। এছাড়া, ইন্টারনেটে জেনেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। জেনেছেন ছোট্ট এ দেশটির অভ্যুদয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। স্বাধীনতার জন্য এদেশের লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে নিজের সম্ভ্রম। তাই তো বিজয়ের মাসে আর ধরে রাখতে পারেননি নিজেকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ফল মনোয়ারার কোন দুঃখ নেই। যুদ্ধশিশু হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না কখনও। কিন্তু কষ্ট হয় সেই নির্যাতিত মায়ের জন্য যিনি একাত্তরে তাকে পেটে ধরেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন সয়েছেন। যাকে তিনি বছরের পর বছর খুঁজে ফিরছেন। একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের বিচারে খুবই খুশি মনোয়ারা ক্লার্ক। বিচারের এ উদ্যোগকে তিনি দেখছেন ‘খুবই ভাল’ হিসেবে। বেশ দেরিতে হলেও এ বিচারের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান মনোয়ারা। দেশে দু’সপ্তাহের মতো থাকবেন মনোয়ারা। এ সময়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের গণকবরসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা ঘুরে দেখতে চান তিনি। এরই মধ্যে সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখেছেন। এসময় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তিনি দেখা করতে চান প্রধানমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে তার আবেদন একটি জন্মসনদ দেয়ার জন্য। যেন বলতে পারেন, ‘আমি তো বাংলা মায়েরই সন্তান’।

No comments

Powered by Blogger.