ছাত্রলীগে আধিপত্যের লড়াই অস্থির ৮ ক্যাম্পাস by নুর মোহাম্মদ

( ২০শে নভেম্বর পুলিশের সামনেই সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সশস্ত্র সংঘর্ষ -ফাইল ছবি ) অস্থির শিক্ষাঙ্গন। সংঘাত-সংঘর্ষে উত্তপ্ত ৮ ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের মুখোমুখি ছাত্রলীগ। ক্ষমতাসীন সংগঠনের কর্মীরা জড়াচ্ছেন অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বিরাজ করছে অস্থিরতা। একটি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিরাজ করছে উত্তেজনা। আর ছাত্রলীগের এ অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ে বলি হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। দীর্ঘ সেশনজটের কবলে পড়ছেন তারা। এই অবস্থায় বৃহস্পতিবার সিলেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বের করে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের মধ্যে সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সেশনজট ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঢোকায় সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া উচিত। এ চিন্তা এখন করতে হবে।
এছাড়াও সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া একটি চিঠিতে শীর্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের কারণে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সুযোগে ছাত্র শিবির, ছাত্রদলসহ অন্যান্য বিরোধী ছাত্র সংগঠন ও স্বার্থান্বেষী মহল অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্টের অপতৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত ও সাতজন আহত হওয়া সংক্রান্ত একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানাতে চিঠি দিতে যাচ্ছে। সেখানে বলা হয়, সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ সংঘর্ষের পেছনে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২০শে নভেম্বর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে সুমন দাস নামে ১ জন নিহত হন। আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ অন্তত ২৫ জন। ছাত্রলীগের অঞ্জন-উত্তম ও পার্থ-সবুজ গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই দিনই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেন। এরপর ক্যাম্পাস এখন অনেকটাই ফাঁকা। ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ। ভর্তি কার্যক্রম চললেও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জানা গেছে, শাবি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জন রায় ও সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য উত্তম কুমার দাস গ্রুপের সঙ্গে শাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ ও যুগ্ম সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সবুজ গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছিল কিছুদিন ধরেই। ঘটনার দিন উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে জড়ো হতে থাকলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টায় উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপ আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা ছাড়াও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় ২৫ জন আহত হন। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের পক্ষ নিয়ে বহিরাগত ক্যাডাররা অংশ নেন। এর মধ্যে সুমন আহমদ নামের এক বহিরাগত ছাত্রলীগ কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এর আগেও কয়েকবার সংঘর্ষে জড়াই ছাত্রলীগ। সর্বশেষ গত রোববার কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসচাপায় নিহত হয় তৌহিদুর রহমান টিটু নামে এক শিক্ষার্থী। ওই ছাত্র নিহতের জেরে বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় ইবি। ওই দিন বেলা ১২টার দিকে চতুর্থ শিফটের বাসগুলো ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় প্রধান ফটকের সামনে এ ঘটনা ঘটে। তার মৃত্যুতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সহপাঠীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি গাড়িতে আগুন ও ৫টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে ৩০ শিক্ষার্থী আহত হন। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের ইবি চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অনাকাঙিক্ষত ঘটনা এড়াতে ওই দিনই জরুরি সিন্ডিকেটে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘট শুরু কারণে দুদিন পর কয়েকটি শর্তে হল ত্যাগ করে শিক্ষার্থীরা। ইবিতে প্রায় ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষ, প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষসহ নানা ইস্যুতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্ররা। এর আগে কয়েক দফা বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, এর আগে ২৪শে সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই দিন সকালে ছাত্রশিবির মিছিল বের করলে ছাত্রলীগের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ পাল্টা মিছিল করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির গাড়ি ও বাসভবন, প্রক্টর কার্যালয় এবং শিক্ষার্থী বহনকারী গাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করে। এ সময় পুলিশ বাধা দিতে গেলে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং ৮-১০ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ছাত্রলীগের ১৩ জন নেতাকর্মী আহত হন এবং পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট সভা করে পরদিন সোমবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. একেএম শফিউল ইসলাম হত্যাকা-ের ঘটনায় ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল বেশ ক’দিন। ভর্তি কার্যত্রুম ছিল বন্ধ। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শিক্ষক সমিতি ১৫ দিনের আলটিমেটাম দেয়। হত্যাকা-কে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাস খুললেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শঙ্কা এখনও কাটেনি এখনও। গত ১০ই সেপ্টেম্বর শিক্ষকদের বাসে বোমা নিক্ষেপকে কেন্দ্র করে ক্লাস বর্জন করে কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক সমিতি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হল খুলে দেয়ার দাবিতে প্রায় দেড় মাস বিশ্ববিদ্যালয় অচল ছিল। এর আগে গত ১৪শে মে ছাত্রলীগের অন্তঃকন্দলের জের ধরে প্রায় দুই সপ্তাহ লাগাতার পরস্পরবিরোধী অবরোধ কর্মসূচিতে ক্যাম্পাস অচল ছিল। ঈদুল আজহার ছুটির নির্ধারিত সময়ের আগেই টানা ৪৩ দিন বন্ধ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়। গত ৯ই নভেম্বর ক্যাম্পাস খোলার প্রথম দিনেই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের জের ধরে আবারও অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। এর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে গিয়ে ছাত্রলীগের এই নেতিবাচক কর্মকা-ের জন্য নাখোশ হয়। ১০ই নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন ও শিক্ষক বাস বন্ধ করে রাখে ছাত্রলীগের একটি পক্ষ। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হলেও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি এখনও নিশ্চিত হয়নি আতঙ্কের কারণে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নাইমুল ইসলাম রিয়াদ খুনের অন্যতম আসামি সুব্রত বিশ্বাসকে আটক করার ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে সেখানে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, পরিস্থিতি বিরূপ হওয়ায় তারা ক্লাসে যাচ্ছে না। পরিস্থিতি শান্ত না হলে তারা আন্দোলনে যাবেন। দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং ভিসির পদত্যাগের দাবিতে সমপ্রতি টানা ধর্মঘট পালন করেছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। গত সপ্তাহে প্রতিষ্ঠান খুললেও এখনও উত্তেজনা বিরাজ করছে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও বহিরাগতদের গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের প্রতিবাদে এবং দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সমপ্রতি ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, বিক্ষোভ-সমাবেশ এবং মানববন্ধন পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানেও কিছু দিন পর ক্লাস বর্জনসহ শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয় এ ধরনের কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। একই অবস্থা বিরাজ করছে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজে (দিমেক)। ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি কমিটিকে কেন্দ্র করে ১৪ই নভেম্বর দুই গ্রুপের সংঘর্ষ পর এখনও ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ আগামী ৩ মাসের জন্য দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাগিদ বলেন, ছাত্রদের এ লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির জন্য পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে দেবো না। শিক্ষা কার্যত্রুম স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে সজাগ থাকারও পরামর্শ দেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যত্রুম স্বাভাবিক রাখার সব ধরনের প্রচেষ্টা আমাদের আছে। তিনি বলেন, নানা ইস্যুতে অস্থির ক্যাম্পাসে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম যারা পরিচালনা করবে তাদের পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি এর ফলে একটি ফলাফল পাবো।

No comments

Powered by Blogger.