দক্ষিণ এশিয়ায় মঞ্চস্থ হচ্ছে আবেগের রাজনৈতিক নাটক by ড. মাহফুজ পারভেজ

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বাস্তবানুগ নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বদলে ‘আবেগের রাজনৈতিক নাটক’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। ধর্ম ও আদর্শের নামে রাজনৈতিক নেতারা ছায়া-যুদ্ধের আবহে জনগণকে জড়িয়ে ফেলেছে। সেই যুদ্ধের হইচই-এর মধ্যেই চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য লাগসই উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দকে  দুর্নীতি ও রাজনৈতিক আবেগের গহ্বর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি।  গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নেপালের কাঠমান্ডুস্থ পার্ক ভিলেজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট-এ দুই সপ্তাহব্যাপী সাউথ এশিয়ান পিস বিল্ডিং ওয়ার্কশপের অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং (এসআইটি)-এর উদ্যোগে আয়োজিত কর্মশালায় বাংলাদেশের তিনজনসহ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সবগুলো দেশের মোট ৩০ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নিচ্ছেন। কর্মশালার পরিচালক প্রফেসর ড. পলা গ্রিন ছাড়াও ড. ক্যাভিন ক্লিমেন্টস দক্ষিণ এশিয়ার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ ভিশন দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে থাকতে হবে। ৪০ বা ৫০ বছর পর কেমন দক্ষিণ এশিয়া চাই, এ সম্পর্কে নেতবৃন্দ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা নেই। ফলে এ অঞ্চলে ভবিষ্যতের প্রেরণা সঞ্চারিত হচ্ছে না। অতীতের সমস্যা নিয়ে সকলেই আবর্তিত হচ্ছেন। তিক্ত অতীতকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগুতে পারছেন না।
সাউথ এশিয়ান পিস বিল্ডিং ওয়ার্কশপে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রধান পাঁচটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে: দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত, জনগণের অংশগ্রহণহীনতা ও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকে চিহ্নিত করা হয়। বলা হয়, বিশ্বব্যাপী সংঘাতের জন্য যে মূল্য দেয়া হচ্ছে, সেটা এ অঞ্চলেও দিতে হবে। কারণ এ অঞ্চলে ভয়ের রাজনীতির মতো সুপ্ত সংঘাত তীব্র নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করেছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে। জনগণের মধ্যে বাস্তুচ্যুতি ও শরণার্থী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করছে। একই সঙ্গে অস্থিতিশীলতা, সীমান্ত উত্তেজনা, হিংসা, সন্ত্রাস ইত্যাদিরও বিকাশ ঘটছে।
সাউথ এশিয়ান পিস বিল্ডিং ওয়ার্কশপে বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়: ১. স্থিতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব এবং দায়িত্বশীল, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছতাযুক্ত সুশাসনের অভাব; ২. সম্পদ ও অর্থের অরাজনৈতিক, আইনানুগ ও ন্যায়সঙ্গত বিতরণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতা; ৩. আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে অনাগ্রহ ও অনীহা; ৪ টেকসই জীবনযাত্রার লক্ষ্যে বাস্তবসম্মত ‘মানবসম্পদউন্নয়ন’ নীতি ও পরিকল্পনার অনুপস্থিতি; ৫. আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সমন্বয়ে একীভূত করা। আলোচনায় আরো বলা হয়, বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার সামনে বিরাজমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো দল বা দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়। নেতার ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থগত কাজের নিরিখে এসব চ্যালেঞ্জকে বিবেচনা করা হলে ঠিক হবে না। বরং এগুলো হলো একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে আর্থ-সামাজিক-প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করার পূর্বশর্ত। সংঘাতমুক্ত শান্তির অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়াকে গড়ে তুলতে হলেও অবকাঠামো, চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদ্যমান সংঘাত ও উস্কানির উপাদান এবং আবেগের আড়াল আর অস্পষ্টতা দ্রুত অপসারণ করে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করাই বাস্তবতার দাবি।

No comments

Powered by Blogger.