অনুমোদন পেতে মোহনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জোর দৌড়ঝাঁপ

বৈধতা না থাকায় কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশে বন্ধ রাখা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মালিকানাধীন হাসপাতাল মোহনা। তবে অনুমোদন পাওয়ার জন্য চলছে জোর দৌড়ঝাঁপ। মোহনা হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন চিকিৎসক এ তথ্য জানিয়েছেন। শুক্রবার রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত মোহনা হাসপাতালের প্রধান ফটক বন্ধ দেখা গেছে। ফটকের সামনে একটি ছোট সাদা কাগজে লেখা ‘মোহনা হাসপাতাল লিমিটেড সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হল’- আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ। এ সময় হাসপাতালের ভেতরে পাহারারত নিরাপত্তাকর্মী খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখানে এসে তিনি কাউকে পাননি এবং হাসপাতাল সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না। ২৯ নভেম্বর রাতে বিশিষ্ট সাংবাদিক জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীকে অচেতন অবস্থায় ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে চিকিৎসা না পেয়ে তাকে অন্যত্র নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মোহনা হাসপাতালে জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরীর যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোশারফ হোসেন এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক এবিএম আবদুল হান্নান পরদিন হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। এ সময় পরিদর্শন টিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লাইসেন্স দেখতে চান। হাসপাতালের কোনো লাইসেন্স নেই বলে এ সময় জানানো হয়। এরপর হাসপাতালের কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতাল পরিচালনা বোর্ডের একজন সদস্য যুগান্তরকে জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে স্বাচিপের কয়েকজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে মোহনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এরপর স্বাচিপ ও বিএমএর আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকরা নিজস্ব হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য ২০১২ সালে মোহনা হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করেন। এ সময় হাসপাতালের তহবিল গঠনে ২৩০ জন চিকিৎসককে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। এর মধ্যে যারা তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা পরিচালনা বোর্ডের সদস্য। যারা তিন লাখ টাকার কম দিয়েছেন তারা হাসপাতালের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বিবেচিত হবেন।
তিনি জানান, হাসপাতাল পরিচালনায় কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এমনকি পরিচালনায় নন-মেডিকেল ব্যক্তিরাও রয়েছেন। যারা চিকিৎসা প্রশাসন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। তিনি আরও জানান, স্বাচিপের একজন প্রভাবশালী নেতা তার ইচ্ছামতো হাসপাতালে দায়িত্ব বণ্টন করতেন। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত সব পরিচালককে না জানিয়ে কয়েকজন মিলে নিতেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের মালিকানাধীন হাসপাতাল বন্ধ করা হবে এটা তারা চিন্তা করেনি। বন্ধ ঘোষণা করার পর লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং তদবির চালানো হচ্ছে। আগামী ৯ ডিসেম্বর হাসপাতালের সার্বিক অবস্থা নিয়ে পরিচালনা বোর্ডের একটি জরুরি সভা ডাকা হয়েছে বলেও জানান তিনি। পরিচালনা বোর্ডের সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক মোকলেসুজ্জামান হিরো যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামীপন্থী ডাক্তারদের আর্থিক নিরাপত্তায় একটি হাসপাতাল করা হবে বলে আমাকে জানালে আমি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। তবে হাসপাতাল পরিচালনায় সরকারি অনুমোদন নেই এটা আমি জানতাম না। তিনি বলেন, হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের পর অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং অনুমোদন পেতে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
পরিচালনা বোর্ডের আরেক প্রভাবশালী সদস্য বিএমএর মহাসচিব ও স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, মোহনা হাসপাতালের পরিচালনা বোর্ডে আমার নাম থাকলেও এই হাসপাতালের সঙ্গে আমি সরাসরি সম্পৃক্ত নই। হাসপাতালের লাইসেন্স আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে ছিল না, তবে এখন আবেদন করা হয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল হান্নান জানিয়েছেন, মোহনা হাসপাতালের লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদন তারা পাননি। তিনি বলেন, আমি এখনও কোনো আবেদন পাইনি। পেলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারা সব নিয়ম নেমে থাকলে অনুমতি পাবে, অন্যথায় পাবে না।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা মোহনা হাসপাতালের আবেদনের বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, ২ ডিসেম্বর অধিদফতরের নির্দিষ্ট শাখায় আবেদনের ফাইলটি জমা দেয়া হয়। মোহনা হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলা ও লাইসেন্স না থাকার বিষয়ে মঙ্গলবার তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. এবিএম আবদুল হান্নানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দেশে কোনো অবৈধ হাসপাতাল থাকবে না। মালিক যতই প্রভাবশালী হোক, অবৈধ সব হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী দেশে সরকার অনুমোদিত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৫টি। অনুমতি ছাড়া কতগুলো আছে সে পরিসংখ্যান অধিদফতরের কাছে নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে উঠছে মোহনার মতো প্রাইভেট হাসপাতাল। যেখানে চিকিৎসার নামে চলে ব্যবসা।

No comments

Powered by Blogger.