হারিছ চৌধুরী, আরিফুল হক জিকে গউসসহ ১১ জনকে নতুন আসামি

সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মেহেরেুন্নছা বেগম হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া খাতুনের আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল উসজিহাদের নেতা মুফতি হান্নান সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জিকে গউছ, মুফতি সফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মোহাম্মদ আলী, বদরুল সহ  ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালে চার্জশিট ও ২০১১ সালে দুবার সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়। ওই সময়  বাদীপক্ষ নারাজি দিয়ে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিলে আদালত আবারও চার্জশিট প্রদানের নির্দেশ দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। ২০০৫ সালে কলঙ্কজনক এ ঘটনাটি ঘটার পর বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহে বিষয়টি তুমুল সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় তোলে। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের সচেতন মহল কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত দু’টি মামলার ৯ বছরেও বিচারকার্য শুরু না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন হবিগঞ্জ তথা সারা দেশের মানুষ। বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন কিবরিয়া পরিবার। ২০০৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি হবিগঞ্জ গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাইপো শাহ মঞ্জুরুল হুদাসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরদিন দিন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমানে হবিগঞ্জ-২ আসনের এমপি এডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর থানায় ১টি হত্যা ও ১টি বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন। হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও বিস্ফোরক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এম সফিউজ্জামান নিযুক্ত হন। ঘটনার পর সিলেট রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি একেএম মাহফুজুর রহমানকে প্রধান  করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা ছিলেন র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্ট উইংয়ের তৎকালীন পরিচালক লে. কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ (পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহে নিহত), সিআইডির সিলেট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুর রহিম, র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক, মেজর মামুন ও সিআইডির সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান। কমিটি ২০০৫ সালের ১৩ই মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মুহম্মদ ওমর ফারুকের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করে। তদন্ত রিপোর্টে কি ছিল তা সে সময় প্রকাশ করা হয়নি।
পরবর্তীকালে হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুন্সি আতিক ৫২ দিন তদন্ত শেষে ২০০৫ সালে ২০শে মার্চ তৎকালীন শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি একেএম আবদুল কাইউম, শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি একেএম আবদুল কাইয়ুম, যুবদল নেতা জয়নাল আবেদীন জালাল, জমির আলী, তাজুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন মুমিন, সাহেদ আলী, সেলিম আহমেদ, আয়াত আলী, মুহিবুর রহমান, কাজল মিয়াসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। কিন্তু মামলার বাদী এডভোকেট এমএ মজিদ খান আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিট অসম্পন্ন দাবি করে অধিকতর তদন্তের  আবেদন জানান। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির আমলের চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করা হলে আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ প্রদান করে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। তিনি সাড়ে ৩ বছরের তদন্ত  শেষে ২০১১ সালের ২৪শে জানুয়ারি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযুক্ত ১৪ জন হচ্ছে নড়াইল জেলার লোহাপাড়া উপজেলার আমজাংগা গ্রামের হরকাতুল জিহাদের সদস্য মইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন গ্রামের মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মহিব উল্লাহ অভি, চাঁদপুর জেলার শৈশাদি গ্রামের শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সাহারপাড়-সৈয়দপুর গ্রামের হাফেজ সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, হবিগঞ্জ জেলা শহরের চৌধুরী বাজার এলাকার বদরুল আলম মিজান ওরফে বাবরী মিজান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার সিকন্দরপুর গ্রামের মিজানুর রহমান মিঠু, পাকিস্তানের ইসলামাবাদের আবদুর রহমান ভাটের পুত্র আবদুল মাজেদ ভাট, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার গুলিপেচা গ্রামের তাজউদ্দিন, কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার বাঁশগাড়ী গ্রামের মুফতি সফিকুর রহমান, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার নয়ানগর গ্রামের মুফতি আবদুল হাই, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নোয়াগাঁও কৃষ্ণপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ও হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা গ্রামের বদরুল মিয়া। এর মধ্যে প্রথমোক্ত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অপর পাঁচজন পলাতক রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কয়েকজন স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় আগের চার্জশিটভুক্ত বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ূমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তাদেরকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে চার্জশিটের বিরুদ্ধে আসমা কিবরিয়ার পক্ষে তার নিযুক্ত আইনজীবী এডভোকেট আলমগীর ভূঁইয়া বাবুল হবিগঞ্জ আদালতে ২০১১ সালের ২৮শে জুন চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি পিটিশন দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১২ সালের ৫ই জানুয়ারি অধিকতর তদন্তের  আদেশ প্রদান করে। দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরেুন্নছা বেগমকে। কিন্তু দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও মামলার তদন্ত কাজ শেষ হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ওই দিন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী ছিদ্দিক আলী, আবদুুর রহিম ও আবুল হোসেনসহ ৫ জন নিহত হয়। নিহতরা একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় তাদের পরিবারগুলো চরম দুঃখ-কষ্টে এখন দিন যাপন করছে। কিবরিয়া হত্যা মামলার বাদী এডভোকেট আবদুল মজিদ খান জানান, জোট সরকারের আমলে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয় এবং মামলাটি স্থগিত করেও রাখা হয়। শুধু তাই নয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। এর পরও আমি থেমে থাকিনি। পুনঃতদন্তের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফখরুদ্দীন সরকার মামলাটি আবারও সচল করার উদ্যোগ নেয়। শেখ হাসিনার সরকার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। ইতিমধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই হত্যায় জড়িত সাবেক স্মরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরসহ মূল পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করেছে।

No comments

Powered by Blogger.