বিরল ব্যক্তিত্ব by ফজলুল হক সৈকত

খুব কম মানুষই ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। আর কেউ কেউ আমাদের আবেগে ও শ্রদ্ধায় এমন করে আচ্ছন্ন করে ফেলেন যে, তিনি চলে গেলে আমাদের ভীষণ খারাপ লাগে। চারদিকে কেমন খালি খালি মনে হয়। সত্যি, মাঝে মধ্যে আমরা বোধহয় কোন কোন অভিভাবককে হারিয়ে ফেলি। কারও কারও প্রস্থান অনন্তকাল অপূরণীয়ই থেকে যায় হয়তো।- হ্যাঁ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এমনই এক ব্যক্তিত্ব। কবি, শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (জন্ম : ২৩ ফেব্র“য়ারি ১৯২৮; মৃত্যু : ১১ নভেম্বর ২০১৪) ছিলেন মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার মূর্ত প্রতীক। শিক্ষক হিসেবে এবং শিক্ষা-প্রশাসক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। সমকালে তিনি ঈর্ষণীয় প্রতিভা এবং প্রায়-অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। প্রগতিশীল এ মানুষটি সবসময় জাতির সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। পার্বত্য-অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য বহু গুণী মানুষ তৈরি করেছেন। শিক্ষাগবেষণায় তার অবদান অনন্য। এছাড়া জাতীয় রাজনীতির জন্যও তিনি এক জরুরি মানুষ। প্রায় ৮ বছর (১৯৭৬-১৯৮৪) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিকী স্যার। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে গণতন্ত্রে উত্তরণের এক নতুন অধ্যায়ে (১৯৯০-৯১) দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নিজের যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ রেখে গেছেন।
কোনো এক হিম-কুয়াশায় ঝিনাইদহে এক শিক্ষক-পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ বরেণ্য সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। কলকাতায় শুরু করেছিলেন স্কুলজীবন। পরে যশোর স্কুল থেকে মেট্টিক পাস করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। দেশ বিভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং ১৯৫১ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৫৪ সালে লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন সিদ্দিকী। অতঃপর তিনি ঢাকা কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। ২০০০-২০০৩ সময়-পরিসরে প্রফেসর জিল্লুর রহমান গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। কিছুকাল বিশ্বভারতীতেও ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন এ বিদ্যাগতপ্রাণ মানুষটি।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সপ্রতিভ বিচরণ ছিল সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। কবিতা, অনুবাদ, গবেষণা, নিবন্ধ, সম্পাদনা, ভ্রমণকাহিনী, অভিধানসহ প্রফেসর সিদ্দিকীর গ্রন্থ সংখ্যা ৪০টি।
সারা জীবন তিনি মুক্তচিন্তা লালন করেছেন। তার নিবন্ধ, অনুবাদ এবং কবিতা পাঠক-প্রিয়তা লাভ করেছে। অনাড়ম্বর ও আকর্ষণীয় বক্তৃতার জন্যও তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমাদের জন্য সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছেন এ মনীষী। লেখালেখির জন্য তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, মনীষী জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর একটি নিবন্ধ থেকে খানিকটা পাঠ নিচ্ছি : ‘অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও বিশ্বাস করতেন, যে ছাত্র উচ্চশিক্ষা শেষে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে যাচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নবিদ্যার বিশেষজ্ঞ হতে চলেছে, তার জন্য ভাষার পেছনে অতিরিক্ত সময় দেয়ার দরকার নেই। দিলে সেটা তার মূল্যবান সময়ের অপচয় হবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে ভবিষ্যতের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের জন্য মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ে ভাষার জায়গা সংকুচিত করা হয়েছিল। ফলে এ-ই হয়েছে যে, আজ চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা ও বিজ্ঞানের ছাত্র তার নিজস্ব বিদ্যার অনুশীলনে এবং সে-বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার পথে সহজ ও দ্রুতগতিতে চলতে পারছে না। দেশী ও বিদেশী ভাষার যোগ্যতা তার জন্যও যে কত জরুরি, তাকে ঠেকে শিখতে হচ্ছে। অথচ দেখে শেখার পথ সবসময়েই খোলা ছিল।’ (বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা: সংকট ও সম্ভাবনা, ঢাকা, ২০০০, ১৪১)- সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যাপক প্রচলন এবং বিশেষ করে শিক্ষার উচ্চপর্যায়ে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে তার এ অভিমত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। তার সমাজ-সাহিত্য-ভাষা-রাজনীতিবিষয়ক গবেষণাগ্রন্থ ‘শব্দের সীমানা’ (১৯৭৬), ‘লিটারেচার অব বাংলাদেশ অ্যান্ড আদার এসেজ’ (১৯৮৩), ‘আমার দেশ আমার ভাষা’ (১৯৮৪), ‘পৃথিবী ও পাসপোর্ট’ (১৯৮৬), ‘শান্তিনিকেতনে তিনমাস’ (১৯৮৯), ‘বাঙালির আত্ম-পরিচয়’ (১৯৯১) ‘প্রবাসে প্রতিদিন’ (১৯৯৪), ‘যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলাম’ (১৯৯৭) আমাদের জ্ঞানভুবনে অনন্য সংযোজন।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কবি হিসেবেই লেখালেখিতে প্রবেশ করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে শিক্ষাবিদ হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছেন বেশি। তিনি কবিতায় প্রেম আর প্রকৃতিকে অনুষঙ্গ করেছেন বারবার। সমুদ্র, পৃথিবী ও বন যে মানুষের প্রকৃত বিচরণক্ষেত্র, তা তিনি বিশ্বাস করতেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার নিবিড় ও বিচিত্র সম্পর্ককে ধরতে তার কবিতাযাত্রা আনন্দদায়কও বটে। এছাড়া সমকাল এবং স্মৃতিকাতরতায় অবগাহন করতে দেখা যায় কবি সিদ্দিকীকে। তার সনেট-পরিক্রমায় রয়েছে দেশাত্মবোধ, আশাজাগানিয়া-ইতিবাচকতা। 'হৃদয়ে জনপদে’ (১৯৭৫), ‘চাঁদ ডুবে গেলে’ (১৯৮৪), ‘আসন্ন বাস্তিল ও অন্যান্য কবিতা’ (১৯৮৮) আমরা এক স্বপ্নবাজ ও সত্য-বান্ধব কবির খোঁজ পাই সত্যি সত্যি। এছাড়া তার ‘শেক্সপীয়রের সনেট’ (১৯৭৭), ‘টেমপেস্ট’ (১৯৮৫) সুখপাঠ অনুবাদ। তিনি সম্পাদনা করেছেন সংকট-উত্তরণের কবি ফররুখ আহমদের ‘মুহূর্তের কবিতা’ (১৯৭৬) এবং ‘হে বন্য স্বপ্নেরা’ (১৯৭৮); রাজনীতি-বিষয়ক নিবন্ধগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৮৯) এবং বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারি’ (১৯৭৩)।
নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা আর দেশপ্রেমকে ধারণ করেছিলেন সমাজ-রূপান্তরের কারিগর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। অবিচল ও নিরন্তর সাধনায় ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন এক বটবৃক্ষ- জাতির বিবেক। শিক্ষা-দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর এ সিদ্দিকী স্যার চলে গিয়ে আমাদের জন্য তৈরি করে গেলেন আরেক শূন্যতা। শিক্ষা এবং সামাজিক উন্নয়নে তার অবদান আমাদের জন্য এক মূল্যবান পাথেয়। জ্ঞানচর্চা, বিচক্ষণতা আর বিনম্রতার বিপুল পাঠ তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের। মানুষটি নিজস্ব প্রচেষ্টায় একটা ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা থেকে আমরা প্রবলভাবে শিক্ষা নিতে পারি। লক্ষ্য করার বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেও তিনি ছিলেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। পক্ষপাতহীনতা, নৈরাজ্যহীনতা এবং আশাবাদ ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় দর্শন। প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে আজীবন কাজ করে গেছেন তিনি।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বিপুল চিন্তা করেছেন জ্ঞানতাপস সিদ্দিকী স্যার। জাতির মনন তৈরিতে তিনি কাজ করেছেন যতেœর সঙ্গে। উদারনৈতিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আমাদের কাছে আলোকের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। তার অসামান্য কর্ম ও অবদান সমকালে যেমন প্রশংসনীয় হয়েছে, উত্তরকালেও তার প্রবাহ থাকবে সচল- এমনটাই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.