আমাদের গায়কপাখি আব্বাসউদ্দীন by ড. নাসের হোসেন

ভারতের অনগ্রসর সমাজের মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক, মাঝি, গাড়োয়ান, মজুরদের সামনে যখন বিনোদনের কোনো প্রশস্ত পরিসর ধরা দেয়নি, সেই প্রত্যুষে গানের পাখি হয়ে আনন্দ ও বিনোদনের ডালি হাতে নিয়ে হাজির হয়েছেন বাঙালির প্রাণের শিল্পী আব্বাসউদ্দীন (জন্ম ২৭ অক্টোবর ১৯০১; মৃত্যু ৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯)। আর কেবল শ্রমিক-মাঝিসহ বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া সামাজিক সম্প্রদায়ের কথাই বা বলি কেন- বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন গানবাজনাকে সংস্কৃতির উপাদান বা বাহন হিসেবে ভাবতে ও গ্রহণ করতে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি, তখন এক প্রতিকূল পরিবেশে সঙ্গীতের সুন্দর সাধনা ও প্রয়োজনীয় প্রচারণার প্রাথমিক ধাপটি ব্যক্তিগত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। সমাজে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসের বিপরীতে মানবিক এবং বৈশ্বিক অনুপ্রেরণা জাগরণ প্রতিষ্ঠা ছিল সাধনার মূল বিষয়। সমাজ-রূপান্তরের আধুনিক ও প্রাগ্রসর এই রূপকার কাজ করেছেন নিবিড় নিষ্ঠা আর প্রাতিস্বিক ভাবনাবলয়ের আভিজাত্যে। মানুষের সরল জিজ্ঞাসার জায়গাটিতে সমাধানের সোনালি ও সম্ভবপর সব প্রলেপ লাগানোর সফল কারিগর এই সঙ্গীতসাধক। তিনি সঙ্গীত প্রচারক ও প্রসারকও বটে।

বাংলা গানের অভিভাবকসম ব্যক্তিত্ব তিনি; বাংলার লোকসঙ্গীত-সংসারের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। আদিনিবাস ভারতের কোচবিহারের তুফানগঞ্জ এলাকায়। পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন জোতদার এবং পেশায় অ্যাডভোকেট। পারিবারিক আবহে, স্বাভাবিকভাবেই, তিনি সামাজিক সঙ্কট ও বিভ্রান্তি অবলোকনের সুযোগ পেয়েছেন। তার মানস গড়ে উঠেছিল সমাজ-রূপান্তরের সমাগত পরিপ্রেক্ষিতের ভেতর দিয়ে। এই স্বভাবশিল্পী তার চার পাশের জীবনাচার, মানুষের প্রাণের তাগিদ, সমাজের গতি ও প্রগতির দিকে প্রসারিত রেখেছিলেন নিজের সাবধানী ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি। শৈশব থেকেই আব্বাসউদ্দীন গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন সরল ও স্বাভাবিক প্রাণময়তায়। অদ্ভুত সুন্দর ছিল তার কণ্ঠ; দারুণ আকর্ষণীয় ছিল গানের গলা। গান আয়ত্ত করার বা মনে রাখার ক্ষমতাও ছিল অবিশ্বাস্য রকম; যেকোনো গান দু-একবার শুনেই অবিকল সুরে গাইতে পারতেন তিনি।
অবিভক্ত ভারতে ও পরবর্তীকালের পাকিস্তানে সঙ্গীতসাধক ও প্রচার-প্রসারক হিসেবে তিনি সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই তিনি সমকালে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। এবং উত্তরকালেও নিজের প্রভাব ও অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছেন কেবল শৈল্পিক সাফল্যের ওপর ভর করে। এই সাধক সঙ্গীতশিল্পী কখনো কোনো শিক্ষকের বা গুরুর কাছে শিক্ষা বা তালিম নেননি।
নিজের প্রচেষ্টায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিখুঁতভাবে গান গাওয়ার রীতি ও কৌশলাদি আয়ত্ত করেছেন মেধা আর কণ্ঠের কারুকাজকে কাজে লাগিয়ে। সঙ্গীতে পারফর্ম ও পাবলিসিটিতে অনন্যসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাকে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ এবং বাংলাদেশ সরকার ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। তবে পুরস্কার দু’টি ছিল মরণোত্তর। এসব সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সম্মাননার গণ্ডির অনেক ওপরে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অবস্থান; যে জায়গাকে ঠিক সীমিত পরিসরের পুরস্কারের কাঠামোয় আঁকা যায় না। আর এ কথাও ঠিক, মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান করায় তিনি আলোকিত হননি; বরং আমরা আনন্দিত হয়েছি; প্রসারিত হয়েছে আমাদের সংস্কৃতির উঠান ও সাধনার শোভা।
স্নাতক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন কালজয়ী এবং উত্তরকালেও অসম্ভব জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন। দেশবিভাগের আগে কলকাতার বাংলা সরকারের রেকর্ডিং এক্সপার্ট এবং পরে অতিরিক্ত সং পাবলিসিটি অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মপরিসরের পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং ব্যক্তিগত ঝোঁকের কারণেই হয়তো বাংলা সঙ্গীত প্রচার ও প্রসারের দিকে তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ও মনোযোগী হয়ে ওঠেন। অবশ্য অন্তরে ছিল প্রকাশের ভার আর সৃজনকর্মের তাগিদ। চাকরিতে প্রবেশের অল্পকাল পরই কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে প্রফেশনালি সঙ্গীতভুবনে প্রবেশ করেন। কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে নজরুলের ‘কোন বিরহীর নয়ন জলে’, ‘স্মরণ পারের ওগো প্রিয়’; শৈলেন রায়ের ‘আজি শরতের রূপ দিপালী’ এবং জীতেন মৈত্রের ‘ওগো, প্রিয়া নিতি আসি’- এ চারখানি গান রেকর্ড করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি তখনকার কলকাতায় গানের ভুবনে জনপ্রিয়তা সৃষ্টিকারী একজন অনবদ্য ও অনুকরণীয় কণ্ঠকারিগর। সঙ্গীতের ভুবনে মোহময়তা ও মায়াজাল বানানোর কৌশলী জাদুকর। আব্বাসউদ্দীনের তারুণ্যভরা ভরাট গলা তখনকার বাঙালি শ্রোতার কাছে ছিল আনন্দঘন অধীর অপেক্ষার বিষয়। নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশে তাঁর সাফল্য আজো আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাসে উজ্জ্বল ইশারা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ‘বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর-/সে আমারি গান প্রিয় সে আমারি সুর’, ‘অনেক ছিল বলার’, ‘গাঙে জোয়ার এলো’, ‘বন্ধু আজো মনে রে পড়ে’- নজরুলের এইসব গানের রেকর্ড প্রচারে চার দিকে প্রবল সাড়া পড়ে যায়। অতঃপর এই সঙ্গীতসাধক নজরুলকে দিয়ে ইসলামি গান লিখিয়ে তাতে কণ্ঠ প্রদান করেন। আর এভাবে সরল ভাবনাকে সম্বল করে, বৃহৎ ও অনগ্রসর মুসলমান সমাজে সঙ্গীতের প্রবাহ প্রচলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সেদিন তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন- বাঙালি মুসলমানের মনে কী ধরনের জীবন-জিজ্ঞাসার বীজ ও বাতাস প্রবাহিত এবং তাতে কোন কায়দায় আনন্দ ও বার্তা প্রবেশ করানো যেতে পারে। বিজ্ঞান ও যুক্তির যুগে কেবল ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি দিয়ে যে সমাজকে, মানুষের চিন্তাকে আর সভ্যতার অগ্রগমনকে বিবেচনা করা বোকামি, সে কথা বুঝতে সমাজলগ্ন শিল্পী ও সংগঠক আব্বাসউদ্দীনের এতটা অসুবিধা হয়নি। আর তার সেই অনুধাবনের জায়গাটি নিজের কাছে গোপন না রেখে, আটকে না ফেলে সাধারণ জনতার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এবং সে অনুযায়ী তিনি সমকালীন সঙ্গীতের ধারা ও সুর সংযোজনে আন্তরিক ও সচেষ্ট ছিলেন সর্বদা। তৎকালীন মুসলমান সমাজের বেশির ভাগ প্রতিনিধি ও সদস্য সঙ্গীতের প্রতি ছিল ভীষণ বীতশ্রদ্ধ। বিশেষত জ্ঞানবিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা এবং যুগের বাণীকে আত্মস্থ করতে না পারার বিষয়াদিই ছিল এর মূল কারণ। গান গাওয়া ও গান শোনা- উভয়ই ছিল তাদের কাছে অধর্মের কাজ। এমন একটি ভীষণ প্রতিকূল প্রতিবেশে সাধারণভাবে মুসলিম সমাজের এবং বিশেষভাবে সব ধর্ম-শ্রেণীর সাধারণ মানুষের প্রাণের চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গীত সরবরাহ করার প্রতি তার অভিনিবেশ সত্যিই আজ নিবিড় গবেষণার বিষয়। আজ এত দিন পরও অনুমান করা যায়, অনুসন্ধিৎসা ও সমাজ-রূপান্তরের অভিজ্ঞান ও আন্তরিকতাই ছিল তার সমূহ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। মুসলমান নাগরিকের চিন্তায় সাঙ্গীতিক আবহ প্রবেশের কৌশল হিসেবে তিনি নজরুলের কয়েকটি গান প্রচারের অভিযানে নেমেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনে করা যায়- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ/এল রে দুনিয়ায়/ আয় রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি দারুণ শ্রোতাপ্রিয় নজরুলসঙ্গীতের কথা। এসব ইসলামি গান শুনে সঙ্গীতের প্রতি তখনকার অনগ্রসর মুসলমান সমাজের আগ্রহ জেগেছিল- যা ছিল সমকালীন সমাজে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই যে একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সঙ্গীতের আনন্দভুবনের দিকে ডেকে আনা- এর প্রায় বেশির ভাগের দায় সেদিন নিয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন। আর কেবল একটি সম্প্রদায়ের কথাই বা বলি কেন- নানান জাতের ও বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি আমজনতাকে গানের বারান্দায়, আড্ডায় ও আসরে হাজির করতে পেরেছিলেন। কাজেই তিনি কেবল একজন কণ্ঠশিল্পী নন; প্রবল নিষ্ঠাবান সঙ্গীত সংগঠক এবং সমাজ রূপান্তরেরও অনন্য কারিগর।

No comments

Powered by Blogger.