নাগরিক বৈষম্য দূর করার তাগিদ -সমতাভিত্তিক নগর ও সামাজিক সম্প্রীতি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক

নগরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, পরিবহনব্যবস্থা, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে নাগরিক বৈষম্য দূর করতে হবে। কমাতে হবে নিম্নবিত্তের প্রতি আচরণবৈষম্যও। থাকতে হবে আইনি সুরক্ষা। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও নেতৃত্ব।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলো আয়োজিত ‘সমতাভিত্তিক নগর ও সামাজিক সম্প্রীতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এমন অভিমত প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সহায়তায় প্রথম আলো কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এটি সঞ্চালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
আলোচনায় ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ), আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা, ভবন নির্মাণকারীদের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অমান্য করাসহ ক্ষমতাশালীদের প্রভাব, সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর সঠিক দায়িত্ব ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনুসরণ না করা, অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাধারণ মানুষের জোরালো উদ্যোগ না থাকা ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে।
বৈঠকে বলা হয়, উচ্চবিত্তদের তুলনায় দরিদ্র বা নিম্নবিত্তরা বাসস্থানের জন্য বেশি টাকা খরচ করেও সুস্থ জীবন পায় না। একাধিক বক্তা সরকারের মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না মেনে জলাধার ধ্বংস করছেন বলে উল্লেখ করেন। সরকারি পক্ষ থেকে ড্যাপের নতুন পর্বে জনপ্রতিনিধি ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত রাখার কথা বলা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও পেশাজীবীদের বক্তব্য মূল্যায়নের উল্লেখ রয়েছে।
বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বলেন, এ দেশে শহরের মধ্যে গ্রাম ঢুকে গেছে। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করবে। তবে খুব জরুরি হলেও আজ পর্যন্ত শহরে গণতন্ত্রায়ণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা করি কিন্তু ড্যাপের মতো, ইমারত নির্মাণ বিধির মতো এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ হয় না।’
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের সভাপতি নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে নগরভিত্তিক সমতা আনতে হলে সুযোগ-সুবিধা সব জায়গায় একইভাবে দিতে হবে। ভূমি, আবাসন, কর্মসংস্থান—সব ক্ষেত্রেই সমতা আনতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া বলেন, রাজউক ভবন নির্মাণে যে নকশার অনুমোদন দেয়, তার ব্যত্যয় না ঘটলে ঢাকা অনেক উন্নত নগর হতে পারত। এটা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজউকের হলেও নকশা লঙ্ঘনের জন্য এককভাবে রাজউককে দায়ী করা উচিত নয়।
২০১৬ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদে ড্যাপের পরবর্তী পর্ব শুরু হচ্ছে, তার বাস্তবায়নে খ্যাতনামা পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অংশগ্রহণ থাকার কথা উল্লেখ করে রাজউক চেয়ারম্যান আরও বলেন, এক মাসের মধ্যে এঁদের নিয়ে একটি পরামর্শক সভা হবে। যে সভা থেকে একটি নীতিমালা বেরিয়ে আসতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনসার আলী খান বলেন, ড্যাপ হাতে পাওয়া গেছে তখনই, যখন কামরাঙ্গীরচর, কাঁঠালবাগানের মতো ঢাকার অনেক এলাকাকে সুপরিকল্পনার মধ্যে আনা সম্ভব নয়। সামনের দিনগুলোতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
সমতার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি বলে উল্লেখ করেন পিপিআরসির সভাপতি হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা নগরভিত্তিক সমতায় বাধা। অর্থনৈতিক প্রয়োজনে গ্রামের মানুষ নগরে আসছে। কিন্তু সুস্থ জীবনের সুযোগ তাদের দেওয়া হয় না। নিম্নবিত্তের সঙ্গে আচরণবৈষম্য না ঘুচলে সমতা আসবে না। দরিদ্রদের নিয়ে একধরনের রাজনৈতিক খেলাও সমতা নষ্ট করছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ব নগর পরিকল্পনার ভিত্তিতে এ দেশে সমতাভিত্তিক নগর পরিকল্পনা করতে হবে। এ জন্য নগরে সমতা, সম-অধিকার, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান সমতাভিত্তিক নগর ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন সমস্যার উল্লেখ করে বলেন, নগরে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোকে দেখা হয় না। সম্পত্তি, আবাসন, অবকাঠামো ব্যবস্থায় জনগণের সম্পৃক্ততা কতখানি তা দেখা হয় না। জনগণকে আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন সব ক্ষেত্রে বৈষম্য কমাতে হবে। নগর শাসনপদ্ধতি চালু রাখতে হবে।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বিনোদন (খেলার মাঠসহ) ইত্যাদিকে একটি নগরের পরিকল্পনায় বাধ্যতামূলক করা হলে নগরভিত্তিক সমতা রক্ষা পাবে। যেখানে সব মানুষের সম্পৃক্ততা থাকবে। তিনি বলেন, শহরে উন্মুক্ত স্থান অনেক আছে, যেখানে খেলার মাঠ করা যায়। কিন্তু সেগুলোর দখল গুটি কতক লোকের হাতে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারি প্রহসনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, অনেক স্থানে জলাশয়কে আবাসন দেখানো হয়েছে। যদিও আগে থেকেই সরকারি রেকর্ডে ওই জায়গাগুলো আছে জলাশয় হিসেবেই। আইন কারা ভাঙেন, কাদের জন্য ড্যাপ পরিবর্তন করতে হয়, তা দেখতে হবে। ড্যাপের সংশোধনে কোনো পেশাজীবীর ভূমিকা নেই।
রিজওয়ানা বলেন, আসলে ঢাকা শহরে কোনো ভিশনই নেই। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন জলাশয় ভরাট করা যাবে না, গণপূর্তমন্ত্রী তার বিপরীত কথা বলেন। তাহলে কি সাধারণ জনগণকে পূর্তমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে হবে?
স্থপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব নগরায়ণ নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শহর অভিমুখিতাকে উৎসাহিত করা হয়। বস্তিবাসীদের জন্য আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ তারা প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য ভাড়া দেয় প্রায় ৩৬ টাকা। শুরু থেকেই ড্যাপকে গলা টিপে মেরে ফেলার জন্য সাত মন্ত্রীকে দিয়ে কমিটি করা হয়েছিল। যেখানে কোনো জনসম্পৃক্ততা রাখা হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের মহাসচিব অধ্যাপক মো. আকতার মাহমুদ স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের (এসটিপি) একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলেন, ৪৪ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করলেও ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প তৈরি ও অনুমোদিত হয়। বস্তিবাসী ৪০ শতাংশ অথচ ১৯৯৩ সাল থেকে কয়েকবার খসড়া প্রস্তুত করেও একটি নীতিমালার অনুমোদন হয়নি। রাজউক ১৩টি আবাসন প্রকল্প করলেও সেগুলো উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের জন্য।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নূরুল্লাহ বলেন, বিভিন্ন পৌর নগরে এলজিইডির সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে সব স্তরের মানুষ অংশ নিতে পারে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এর কোনো বিধিমালা না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধি আশেকুর রহমান বলেন, সারা দেশের পাঁচজনের একজন নগরে বাস করে। বাংলাদেশে গ্রামীণ দারিদ্র্য নগর দরিদ্র থেকে কম। নগরে বস্তি ও বস্তিবহির্ভূত খাতকে এক করে দেখতে হবে।
শেল্টেক্ লিমিটেডের উপনগর পরিকল্পনাবিদ হিশাম উদ্দীন চিশতি বলেন, শহরের মূল পরিচয় হতে হবে ‘মনুষ্য বসতি’। এর সঙ্গে যুক্ত হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সমতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.