কারবালার বিশ্বাসঘাতকেরা by রুমানা আক্তার রুমা

কারবালার যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের হাজারো করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার একটি। ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালার ময়দানে হজরত হুসাইন রা: ও ইয়াজিদ বাহিনীর মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ঘটনার নেপথ্যে যারা কাজ করছে তারা ইতিহাসের পাতায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। হজরত হুসাইন রা: ও তার পরিবারবর্গের শাহাদতের পরপরই ওই সব নেপথ্য নায়কদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

১. ইয়াজিদ : ইয়াজিদের কারণেই কারবালা প্রান্তরে হজরত হুসাইনকে শহীদ করা হয়। কারবালা যুদ্ধের পর মুসলিম দুনিয়ায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিশেষ করে মক্কা-মদিনার অধিবাসীরা এমন বিয়োগান্ত ঘটনার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে লাগল। ইতোমধ্যে ইয়াজিদ বাহিনী মক্কা-মদিনা আক্রমণ করে বহুসংখ্যক লোককে শহীদ করল। এমনকি ইয়াজিদের বাহিনী পবিত্র কাবা শরিফে অগ্নিসংযোগ করে। যেদিন কাবা শরিফে আগুন দেয়া হয়েছিল সেদিন ইয়াজিদ এক অজ্ঞাত রোগে দামেস্কে মারা যায়। তার অনুসারীরা রাতের আঁধারে অজ্ঞাত স্থানে তাকে কবর দেয়। আজ পর্যন্ত কেউ ইয়াজিদের কবরের সন্ধান পায়নি। ইয়াজিদের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাবিয়া আসগরের হাতে লোকেরা বাইয়াত গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। কিন্তু সে তাতে রাজি হয়নি। এরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ৪০ দিন পর মারা যায়।
মুখতার সকফির যথার্থ প্রতিশোধ গ্রহণ : ইয়াজিদের মৃত্যুর কিছু দিন পর মারওয়ান ক্ষমতা দখল করে। তখন মক্কা-মদিনা ও কুফাসহ সমগ্র আরব বিশ্বে বিদ্রোহ চরম আকারে দেখা দিলো। কুফাবাসী বেশি অনুতপ্ত ছিল। কেননা তাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল। তারা ভাবল, কিভাবে এর প্রায়শ্চিত্ত করা যায়। কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ পালিয়ে দামেস্কে চলে যায়। মুখতার সকফি কুফায় গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুখতার সকফি ইমাম হুসাইনের শাহাদতের বদলা নেয়ার জন্য ডাক দিলেন। সাথে সাথে সমগ্র কুফাবাসী তার আহ্বানে সাড়া দিলো। শুরু হলো প্রতিশোধ নেয়ার পালা।
১. আমর বিন সাদ ও তার ছেলে : সর্বপ্রথম সেই নরাধম, পাপিষ্ঠ আমর বিন সাদকে তলব করা হলো, যে ইয়াজিদের বর্বর বাহিনীর সেনাপতি ছিল এবং তারই পরিচালনায় কারবালায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তার ছেলে এসে বলল, আমার পিতা এখন সব কিছু ত্যাগ করে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। সে ঘর থেকে বের হয় না। সকফি কোনো অজুহাত গ্রহণ করলেন না। তারপর তাকে ধরে এনে পিতা-পুত্রের মাথা কেটে মদিনা শরিফে মুহাম্মাদ বিন হানফিয়া রা:-এর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
২. হাওলা বিন ইয়াজিদ : হাওলা বিন ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনের মস্তক দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে ধরে এনে হাত-পা কেটে শূলে চড়ানো হলো। তার লাশ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
৩. সিমার : এই সিমার ইমাম হুসাইনের গলায় ছুরি চালিয়েছিল। মুখতার সকফি যখন ইমাম হুসাইন রা:-এর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী একেকজনকে হত্যা করছিলেন তখন পাপিষ্ঠ সিমার কুফা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ পাপিষ্ঠের শেষ রক্ষা হয়নি। সে মুখতার সকফির বাহিনীর হাতে ধরা পড়ল। তারা তাকে দুই টুকরা করে মুখতার সকফির কাছে পাঠিয়ে দেয় এবং লাশ কুকুরকে দেয়া হয়।
৪. হাকিম বিন তোফায়েল : এই নরাধম, যে হজরত আব্বাস রা:-এর শরীর থেকে পোশাক খুলে নিয়েছিল এবং ইমাম হুসাইনের প্রতি তীর নিক্ষেপ করেছিল, তাকেও হত্যা করা হয়েছিল এবং তার মাথা বর্শার অগ্রভাগে উঠিয়ে মুখতার সকফির সামনে আনা হয়েছিল।
৫. জায়েদ বিন রেকাত : এই জালিম, যে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে আকিল রা:-এর কপালে তীর নিক্ষেপ করেছিল। তাকে ধরে এনে জীবিত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
৬. উমর বিন সবি : এই লোক হজরত ইমাম হুসাইন রা:-এর সাথীদেরকে তীর নিক্ষেপ করে আহত করেছিল। তাকে ধরে তীরের আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।
৭. আমর বিন সবি : এই আমর বিন সবি, যে গর্ব করে বলে বেড়াত, ‘আমি হুসাইনের কোনো সাহাবিকে হত্যা করার সুযোগ পাইনি বটে, কিন্তু তীর নিক্ষেপ করে অনেককে জখম করতে সক্ষম হয়েছিলাম। একে ধরে সবার সামনে বর্শার আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।
৮. নরাধম ইবনে জিয়াদের করুণ পরিণতি : ইয়াজিদের পর এই নরাধম ইবনে জিয়াদ সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী। কারবালার ঘটনার সময় এই ব্যক্তি কুফার গভর্নর ছিল। মুখতার সকফি এই নরাধমকে হত্যা না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি ইব্রাহিম বিন মালেক আলতাবের নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী ইবনে জিয়াদকে পরাস্ত করার জন্য প্রেরণ করেন। মুসল শহরের কাছে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে ইবনে জিয়াদের বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ইবনে জিয়াদ পলায়নকালে ইব্রাহিম মালেকের সৈন্যবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ইব্রাহিম মালেকের সৈন্যরা ইবনে জিয়াদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মাথা বর্শার অগ্রভাগে তুলে কুফায় নিয়ে আসে। তখন সকফি কুফাবাসীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আজ থেকে ছয় বছর আগে এই দিনেই এই জায়গায়, এই জালিমের সামনে ইমাম হুসাইন রা:-এর মস্তক রাখা হয়েছিল। আজ আমার সামনে সেই জালিমের মাথা রাখা হয়েছে।’ এই সময় হঠাৎ একটি সাপ এসে ইবনে জিয়াদের নাকের ভেতর দিয়ে মস্তকে প্রবেশ করে বের হয়ে গেল। এই রূপ তিনবার করে সাপটি অদৃশ্য হয়ে গেল। এভাবে মুখতার সকফি কারবালার শহীদদের পবিত্র রক্তের যথাযথ বদলা নিয়েছিলেন।
লেখক : প্রবন্ধকার

No comments

Powered by Blogger.