রংপুরের কলঙ্কতিলক দূর হবে কি? by তুহিন ওয়াদুদ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি যৌথভাবে সম্প্রতি বাংলাদেশের দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে রংপুর বিভাগ বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র বিভাগের স্থান পেয়েছে। রংপুর বিভাগের প্রায় দুই কোটি মানুষ চার কোটি মানুষের খাদ্যচাহিদা পূরণ করার মতো খাদ্যশস্য উৎপাদন করেও কেন দারিদ্র্যের শীর্ষে? কেন তাকে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের কলঙ্কতিলক পরতে হবে? রংপুরের প্রতি সরকারের অবহেলা চোখে পড়ার মতো। কোনো সরকারের অর্থমন্ত্রীই রংপুরে এসে তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ নির্ণয়ে সচেষ্ট হননি। বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তো মঙ্গা শব্দের অর্থই জানতেন না।
তা ছাড়া এ পর্যন্ত যতবারই বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে, প্রতিবারই রংপুরের জন্য বাজেট ছিল তুলনামূলক কম। প্রতিবছর বাজেট কম থাকলেও এ নিয়ে প্রতিবাদ করার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো সাংসদ না থাকার কারণে এর পুনরাবৃত্তি চলছেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের নয় বছরে পশ্চাৎপদ রংপুর বিশেষ কোনো সুবিধা লাভ করেনি। শহরে কিছু নিয়নবাতির ব্যবস্থা হয়েছিল মাত্র; যার আলোয় পোশাকের রং, গায়ের রং বদলে যায়, দারিদ্র্যের রং বদলায় না। এরশাদের পর বিএনপি, আওয়ামী লীগ, চারদলীয় জোট, মহাজোট—সব সময়েই রংপুর বিভাগের অধিকাংশ সাংসদ ছিলেন জাতীয় পার্টির। ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ না থাকার কারণে রংপুরের উন্নয়ন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছে।
সারা দেশের তুলনায় অভিবাসীর সংখ্যা রংপুরে সবচেয়ে কম। রংপুর বিভাগে প্রতি গ্রামে গড়ে একজন করে অভিবাসী পাওয়া যাবে না। অথচ রংপুর বিভাগ বাদ দিলে অন্যান্য বিভাগে প্রায় প্রতিটি বাড়ির কেউ না কেউ বিদেশে থাকেন। সরকারের উচিত রংপুরের মানুষের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, বিনা সুদে ঋণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো। পোশাকশিল্পে যে শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাঁদের বড় অংশই রংপুরের। তাঁদের শ্রমে দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আসে, আর তাঁদের জীবনে আসে রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের মতো ট্র্যাজেডি।
বর্ষা মৌসুমে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক ভাঙন হয়। চরে যারা বাস করে, তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, আয়ের কোনো সুব্যবস্থা নেই। নদীগুলো রক্ষার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলে নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে অভিশাপ রূপে দেখা দিচ্ছে। রংপুর অঞ্চলের অভাব আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকে, তাহলে সেখানে সেচ প্রকল্প বন্ধ হবে। সে ক্ষেত্রে আবারও রংপুর হয়ে উঠতে পারে মঙ্গাকবলিত।
দারিদ্র্য-মানচিত্রে কুড়িগ্রামকে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সারা দেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে কুড়িগ্রামে এই হার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। কুড়িগ্রাম জেলায় ১৬টি নদী রয়েছে এবং প্রতি বর্ষায় ব্যাপক ভাঙনের শিকার হয়। কুড়িগ্রামে বন্যা-ভাঙনের সঙ্গে সরকারের অবহেলাও যুক্ত হয়েছে। অথচ চিলমারী বন্দর ও সোনাহাট স্থলবন্দর চালু করলেই কুড়িগ্রামের অর্থনীতি বদলে যেতে পারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই স্থলবন্দর চালু হলে এবং চাহিদা অনুযায়ী শিল্পকারখানা স্থাপন করা গেলে কুড়িগ্রাম হতে পারে দেশের সবচেয়ে ধনী জেলা। সোনাহাট স্থলবন্দরের সঙ্গে ভারতের সেভেন সিস্টারস—আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল রাজ্যগুলোর সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। তা ছাড়া এই স্থলবন্দরের সঙ্গে রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে, যা দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরের সঙ্গে নেই।
কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের জন্য দীর্ঘদিন ধরে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি আন্দোলন করে আসছে। অথচ এই একটি ট্রেন কুড়িগ্রামের জন্য খুবই প্রয়োজন। কুড়িগ্রামের সাধারণ মানুষ এতে অনেকটাই উপকৃত হবে। গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে একটি সেতু স্থাপন করা গেলে মাত্র চার ঘণ্টায় রেল ও সড়কযোগে রংপুর-ঢাকা যাওয়া-আসা করা যেত। ঢাকা থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করা সহজ হবে।
রংপুর বিভাগের দারিদ্র্য দূরীকরণে যে রাজনীতিবিদদের করণীয় সবচেয়ে বেশি, তা হয়তো তাঁরা ভুলে গেছেন। তাঁরা ভুললেও ভুলবে না এনজিওগুলো। তারা এই দারিদ্র্যকে পুঁজি করে বিদেশ থেকে অর্থ নিয়ে আসবে, হতদরিদ্রদের লোক দেখানো একটি গরু অথবা একটি ছাগল দিয়ে তার আড়ালে গরিবের ঋণের বোঝা আরও ভারী করে তুলবে। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, সে খবর কেউ রাখবে না। রংপুর বিভাগের অধিকাংশ বিত্তহীন পরিবারের ওপর রয়েছে এনজিওর ঋণের বোঝা। তারা প্রতিদিন ঘুমাতে যায় পরের দিনের কিস্তির টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে, সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে।
রংপুরের অর্থনীতি সম্ভাবনাময়। সরকার যদি প্রণোদনা দেয়, রংপুরে গ্যাসের ব্যবস্থা করে অথবা, ফুলবাড়ীর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ রংপুর বিভাগের শিল্পকারখানার জন্য স্বল্পমূল্যে দিয়ে শিল্পকারখানা গড়ে তোলে, তাহলে রংপুরের মানুষের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। রংপুর এখন হাঁড়িভাঙা আমের জন্য বিখ্যাত। সরকারি সহায়তায় যদি রংপুরে এই হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেত, তাহলেও এখানকার মানুষ আম চাষ করে সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারত। রংপুরের শতরঞ্জি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে শুধু রংপুরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হতো তা নয়, এই শতরঞ্জি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করতে সহায়ক হতো। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় যে বেনারসিপল্লি রয়েছে, তার প্রতিও কোনো সহযোগিতা নেই। রংপুরে কৃষিজাত কারখানাসহ সব রকম কারখানাই গড়ে উঠতে পারে। বরং দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে রংপুরে কম মূল্যে শ্রম পাওয়া সম্ভব। রংপুরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে উদ্যোক্তারাও লাভবান হবে, এলাকাবাসীরও কল্যাণ বয়ে আনবে।
২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা করতে হলে রংপুর বিভাগের দরিদ্র অবস্থা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। ন্যাশনাল সার্ভিসের মতো কর্মসূচির পরিবর্তে কর্মমুখী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। রংপুরের মানুষের জন্য কাজের ক্ষেত্র সরকারকেই সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের সংবিধানে রয়েছে পশ্চাৎপদ জনগণের জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের এগিয়ে নেওয়ার কথা। রংপুর বিভাগ যেহেতু পশ্চাৎপদ, তাই এ বিভাগকে এগিয়ে নেওয়া এখন সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.