ষড়যন্ত্র আর দ্বন্দ্বের সময়ে ভিআইপি বিয়ে by দেবদীপ পুরোহিত

অনেকে মনে করতে পারেন পরিস্থিতি এর থেকে আর খারাপ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর চলছে হরতাল। জীবনের আনন্দের উপলক্ষগুলোতে একান্ত মনোযোগ দেয়ার খুব একটা আদর্শ সময় নয় এটা, তাই না? কিন্তু আসলে কি তাই! হত্যা, ষড়যন্ত্র আর ফাঁসির রায়ের রূঢ় বাস্তবতা থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেক বাংলাদেশী একটি আনন্দের উপলক্ষে নিবিড় মনোযোগ রেখেছে। ঢাকা থেকে আসা রিপোর্টগুলো বলছে, বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার দেখতে জনসাধারণের বড় একটি অংশ বুধবার টেলিভিশনের পর্দায় চোখ আটকে রেখেছিল। এ মাসের শুরুতে ২৯ বছর বয়সী হনুফা আকতার রিক্তাকে বিয়ে করার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে চমক দেন ৬৭ বছর বয়সী এ রেলমন্ত্রী। এর আগে আশীর্বাদ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। তিনি এত দিন ছিলেন কুমার। ভারতীয় রাজনীতি বা ভারতের রেল মন্ত্রণালয়ের চিরকুমারত্বের বিষয়টা অপরিচিত নয়। মুজিবুল হক ও রিক্তা উভয়েই কুমিল্লার। সেখানেই আজ এ যুগল বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। পাত্র পক্ষের তরফ থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের হলে বউভাত হবে ১৪ই নভেম্বর। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘কোন বিয়ের অনুষ্ঠান দেশে এতটা আগ্রহের সৃষ্টি করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। বিশেষ ট্রাইবুন্যাল যেদিন মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন এবং তা নিয়ে সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে, সেদিনই কমপক্ষে ৬টি টেলিভিশন চ্যানেল ওই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেছে।’ অনেক সাংবাদিক অনুষ্ঠানের আবহ ধারণ করতে হলুদ পাঞ্জাবি পরেন। রায়ের পরপরই জামায়াত সমর্থকরা দেশব্যাপী তিন দিনের (গতকাল, রোববার ও সোমবার) হরতালের ডাক দিয়েছে। জামায়াত ও শিবির কর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। এটা এ বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগ দিয়ে সহিংস হরতালের স্মৃতিই মনে করিয়ে দেয়, যে নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। যে দেশে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় চরম বিভক্তি রয়েছে, সেখানে ওই নির্বাচন সঠিক ছিল না ভুল- সে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। টকশোতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা দেশটিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিতর্কসাপেক্ষ প্রসঙ্গের অভাব নেই। এর মধ্যে আছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্র নীতি থেকে শুরু করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আরও বলেন, ‘ঘোষণার পর থেকেই এই বিয়েটা মুখে মুখে আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বাঙালিরা দারুণ রসিক আর আমরা জানি চূড়ান্ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও কিভাবে হাসতে হয়।’ আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, আইনে স্নাতকোত্তর এবং এক কৃষকের সন্তান মুজিবুল হক আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদমর্যাদা পেরিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। তার বিয়ের প্রসঙ্গটা মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকেও স্থান করে নিয়েছে। কোন একটি কাকতালীয় কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিষয়টা হালকাভাবে আলোচনা করেছে। ওই সূত্র জানায়, এ মাসের শুরুতে মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে তার বিয়ের প্রসঙ্গটা উঠে আসে, যখন রেলমন্ত্রীর নামধারী শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জানান যে, তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কেননা মানুষ তার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে জানতে চাইছেন। সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, এই বিয়ে নিয়ে দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু নেতা মনে করেন মুজিবুল হকের উচিত ছিল তার বিয়ের অনুষ্ঠানটি অনাড়ম্বর রাখা। পক্ষান্তরে অনেকে মনে করছেন, বড় আকারের অনুষ্ঠান করাতে ভুল কিছু নেই। কেউ আবার বলেছেন, হক সাহেব রাজনীতিতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, বিয়ে করার সময় হয়ে ওঠেনি। একেবারে না হওয়ার থেকে দেরি হওয়া ভাল। সঙ্গী খুঁজে নেয়ার ক্ষেত্রে বয়স যে কোন প্রতিবন্ধকতা নয় সেটা কোন জনপ্রতিনিধি এবারই প্রথম প্রমাণ করলেন তা নয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ.এম. এরশাদ ৭১ বছর বয়সে ৩০ বছরের নারীকে বিয়ে করেছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ সত্তরোর্ধ্ব বয়সে ৩৫ বছরের নারীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। মুজিবুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করার মাধ্যমে দলের মধ্যে ঠাট্টা, বিদ্রূপের উপলক্ষ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বকে জানিয়েছেন যে, এ বিয়েতে প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ রয়েছে। নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪ ডট কম মুজিবুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ‘আমি আমার নেত্রীর কাছে আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলাম। বিয়ের সব কিছু যেন ভালভাবে সম্পন্ন হয় তিনি সে দোয়া করেছেন। প্রার্থনার পর দলের নেতারা আনন্দিত। জনগণ আনন্দিত। আর এ কারণেই মানুষ তাদের ভালবাসা দিয়ে আমাকে সিক্ত করেছে।’ বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও অন্য নেতারা বুধবারের অনুষ্ঠানে ছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বউভাতে অন্য শীর্ষ নেতাদের উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আশীর্বাদে কাজ হয়েছে।
(গতকাল কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.