আইসল্যান্ডের জাতীয় কবি ওনাস হলগ্রিমসন by ড. শাহাজাদা বসুনিয়া

আইসল্যান্ডের জাতীয় কবি ওনাস হলগ্রিমসনের (---) বিচরণ শুধু কবিতায় ছিল না; বরং তিনি একজন লেখক ও প্রকৃতিবাদী হিসেবে আইসল্যান্ডে পরিচিত ছিলেন। তিনি আইসল্যান্ডিক জার্নাল ফোলনির (ঋলড়ষহরৎ) -এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন; যা ১৮৩৫ সালে কোপেনহেগেনে প্রথম  প্রকাশিত হয়। এই জার্নালটি আইসল্যান্ডিক জাতীয়তাবাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করত। শুধু তাই নয়- আইসল্যান্ডিক ইন্ডিপেন্ডেন্স ম্যুভম্যান্টকে ত্বরান্বিত করে এই জার্নাল। তার কবিতা আইসল্যান্ডে বহুল পরিচিত যা দেশ ও জনগণকে ঘিরে রচিত। ফলে আইসল্যান্ডের জনগণের প্রিয় কবি হচ্ছেন ওনাস হলগ্রিমসন। কবি ওনাস হলগ্রিমসন আইসল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে ১৮০৭ সালের ১৬ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হলগ্রিমুর পোরসটিনসন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার ভাই পোরসটিন ১৮০০ সালে, রেনভিগ ১৮০২ সালে এবং আনা মারগ্রেট ১৮১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮১৬ সালে ওনাসের বাবা একটি হ্রদে ডুবে মারা যাওয়ার পর তাকে ফুপুর তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়; কিন্তু ১৮২১ সালে তিনি পুনরায় তার জন্মভূমি অক্সনাডুলারে ফিরে আসেন। সেখানে একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। পাদ্রি ইনার এইচ থার্লাচার্স-এর তত্ত্বাবধানে দু’বছর লেখাপড়া করার পর বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে অন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। ১৮২৯ সালে তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করে রাইকয়াভিকে চলে আসেন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করণিক পদে কাজ শুরু করেন। করণিকের কাজের পাশাপাশি তিনি ডিফেন্স উকিল হিসেবে কাজ করতেন। ধারণা করা হয় যে, ১৮৩১-১৮৩২ সালের শীত মৌসুমে নুডসেন নামে এক মহিলাকে প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। এমনকি প্রেমে ব্যর্থতার কারণে তার জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। ১৮৩২ সালে তিনি ডেনমার্কের উদ্দেশে রওনা হন। ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেন থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। শিক্ষাজীবনশেষ করার চার বছর পর তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। আইসল্যান্ডের শিক্ষা জীবনের চারজন সহপাঠীকে সাথে নিয়ে তিনি এই পিরিওডিক্যাল জার্নাল ফোলনির (ঋলড়ষহরৎ) চালু করেন। ¯œাতক ডিগ্রি অর্জনের পর রাজস্বকোষ থেকে তিনি অনুদানপ্রাপ্ত হয়ে বিজ্ঞানের ওপর গবেষণা শুরু করেন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রকল্পে কাজ করেন। আইসল্যান্ডের ন্যাচারেল হিস্ট্রির ওপর তিনি সারা জীবন গবেষণা অব্যাহত রাখেন। ফোলনির জার্নালে তার অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশী অনেক বিষয়ের ওপর লেখা প্রবন্ধকে তিনি অনুবাদ করেন, যা আইসল্যান্ডের সাহিত্য ও বিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখে।
কবি ওনাস হলগ্রিমসন আইসল্যান্ডের সাহিত্যে প্রথম রোমান্টিক ধারার প্রবর্তন করেন। আইসল্যান্ডের নিসর্গকে ধারণ করে তার লেখনীতে সার্থকভাবে ইমেজারি প্রয়োগ করেন তিনি। তার কবিতায় বিদেশী ছন্দ যেমন; প্যারামিটার ব্যবহার করে তিনি আইসল্যান্ডের কবিতাভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেন। একটি কবিতার অনুবাদ দেয়া হলো :
‘তুমি হচ্ছো মনোরম ও সুন্দর ভূমি ,
এবং যুকুলস (হিমবাহ)-এর চূড়া শুভ্র-সাদা,
মেঘহীন নীল আকাশ,
ওশান ঝিকিমিকি উজ্জল,
কিন্তু মাঠগুলো উঁচু যেখানে
ওসার নদী বয়ে চলে নিরবধি,
আর স্রোতস্বিনী মিশে যায় আলমানায়,
কোনোকিছু এখানে ধরে রাখা যায় না,
অথচ এখন সব জায়গা হচ্ছে চারণভূমি,
লগবার্জের গুল্ম অতি পবিত্র
আর মূল্যবান পাথরগুলো প্রতি বছরে
নীল হয় সবার কাছে, সন্তানের কাছে।
পূর্বপুরুষের অর্জিত খ্যাতি কিভাবে
ভুলে যাই, প্রিয় আইসল্যান্ড আমার।’
কবি ওনাসের বাবার মৃত্যুর ২০ বছর পর তিনি খধু ড়ভ এৎরবভ কবিতায় তার বাবার মৃত্যুর বিয়োগান্তক স্মৃতিচারণ করেন। নৌকা থেকে পড়ে হ্রদে তার বাবার মৃত্যুকে তিনি প্রতিনিয়ত স্মরণ করতেন বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে। নি¤েœ কবিতাটির অনুবাদ দেয়া হলো:
“আমি একজন বালক ছিলাম মাত্র
যখন দৃষ্টিহীন হ্রদের পানিতে
তার দৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়
এবং সারা জীবনের জন্য স্তব্ধ করে দেয় তাকে,
অথচ আমি কিছুই ভুলি নাই
যা ছিল শোকাহত অপূরণীয় ক্ষতি-
পৃথিবীতে এটিই প্রথম-
যখন আমার বাবা মৃত্যুবরণ করেন।
আমি স্মরণ করি
তার আত্মার অবিচল শক্তি,
তার পুরাদস্তুর আদর
যা তার চক্ষু থেকে প্রতিফলিত হতো;
তারা অতি উৎসাহে ভালবাসা বিতরণ করে
যেন বিধাতার আশীর্বাদের সূর্যালোকের
আলোকে সবুজের সমাহার।
আমার মনে পড়ে মায়ের অশ্রু বিসর্জন,
তিনি জানতেন বাবা আর ফিরে আসবে না
কখনো, তার ভালবাসা তাকে
আলোকিত করবে না জীবনে।
এমনকি তার সন্তানদের,
একি এক অনন্ত প্রস্থান।”
২১ মে, ১৮৪৫ সালে কবি ওনাস হলগ্রিমসনের জীবনাবসান ঘটে। মাত্র ৩৭ বছরে ব্লাড পয়জনিং- এ তিনি মারা যান। কোপেনহেগেনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়; কিন্তু ১৯৪৬ সালে তার দেহাবশেষ কোপেনহেগেন থেকে আইসল্যান্ডে এনে পুনঃসমাহিত করার প্রয়াস নেন সিজারসন পিটারসন নামের তার এক শুভাকাক্সক্ষী । তদানিন্তন আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এতে বাধা দিয়ে বলেন যে, কবি হলগ্রিমসন রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুতরাং তাকে জাতীয় কবরস্থানে সমাহিত করা হবে। দেহাবশেষ বহনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ও যানবাহন বরাদ্দে সরকারের অনীহার কারণে সিজারসন পিটারসন নিজেই সমুদয় ব্যয়ভার বহন করে কবির দেহাবশেষ আইসল্যান্ডে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য যে, তার পুনঃঅন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে পুরোহিতের অনীহার ফলে তার কফিন একটি গির্জায় এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরবর্তীতে আইসল্যান্ড সরকারের পছন্দের জায়গায় তাকে ১৬ নভেম্বর ১৯৪৬ সালে পুনঃসমাহিত করা হয়। তাকে স্মরণ করার জন্য এই দিনটি আইসল্যান্ডে ল্যাংগুয়েজ ডে হিসেবে উদ্যাপন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.