সড়ক দুর্ঘটনা- পুলিশ কর্মকর্তার অভিমত by মো: সালাহউদ্দীন

প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র। সম্প্রতি নাটোরের বড়াই গ্রাম এলাকায় যাত্রীবাহী দু’টি বাসের সংঘর্ষে হতাহাতের ঘটনা অতীত রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একটি দুর্ঘটনায় ৩৬ জন মানুষের প্রাণ চলে যাবে, তা ভাবা যায় না। অতীতে মানিকগঞ্জ জেলায় দু’টি পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন সচিবসহ তারেক মাসুদ ও মিশুক মনির নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। দিন দিন যেন এই লাশের মিছিল বেড়েই চলেছে; কিন্তু এখন প্রশ্ন, কেন এত দুর্ঘটনা? এ থেকে বাঁচার উপায়ই বা কি? পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট দুর্ঘটনা হয়েছে দুই হাজার সাত শ’র বেশি। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। আর প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই গাড়িচালকদের অদতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
আমি মাঠপর্যায়ের একজন পুলিশ অফিসার। চাকরিজীবনে বহু দুর্ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার বহু কারণ রয়েছে। এসব বিষয়ে আমার কিছু লেখা আছে। সে বিষয়ে স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব না হলেও আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালক নিজে। আমাদের দেশের চালকদের রোড সাইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। কোথায় ওভারটেক করা যাবে কিংবা যাবে না, সেটা বেশির ভাগ চালক জানেন না। নাটোরের দুর্ঘটনাটি অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে চালকের ইচ্ছামতো ওভারটেক করার প্রবণতা ছিল। সবার জানা উচিত মহাসড়কে কোনো টার্নিং পয়েন্ট বা ব্রিজের কাছের রাস্তার মাঝখান দিয়ে যে সাদা লম্বা দাগ চলে গেছে এটাকে বলা হয় ওভারটেকিং নিষিদ্ধ সাইন। একজন চালকের উচিত ওভারটেকিং নিষিদ্ধ সাইন থাকা অবস্থায় ওভারটেক না করে রাস্তার বাম পাশে দিয়ে গাড়ি চালানো। এ পর্যন্ত যত মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগ ঘটেছে এই টার্নিং পয়েন্টে। একে বর্তমান ‘ব্লাক স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার মূল কারণ বেপরোয়া খেয়ালখুশিমতো ওভারটেক করা। আমাদের দেশের চালকদের দেখে মনে হয় তাদের দেখার কেউ নেই। তাই এরা ইচ্ছামতো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসব দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বর্তমান বেশি বেপরোয়া বাসের চালকেরা। একজন বাসচালকের মনে রাখা উচিত তার ওপর নির্ভর করছে বাসে অবস্থানকারী সবার জীবন এবং তার সাথে জড়িত তাদের পরিবারের জীবন।
প্রথম প্রস্তাব : দু’টি পদ্ধতির মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। যেহেতু বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটায় বাস ও ট্রাক। তাই রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সময় বিআরটিএ থেকে প্রতিটি গাড়িতে স্পিড লিমিট গভর্নর সিল সংযুক্ত করে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এ পদ্ধতি আশির দশক পর্যন্ত প্রচলন ছিল। এ েেত্র বাস ও ট্রাকের জন্য সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে গভর্নর সিল সংযুক্ত করা প্রয়োজন। চালক পরে এ সিল পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে অবশ্যই গাড়ি আটকের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব : যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালক নিজে, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জেলা পুলিশ এবং হাইওয়ে পুলিশকে পর্যাপ্ত স্পিড ডিটেক্টর সরবরাহ করা যেতে পারে। স্পিড ডিটেক্টর সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা নেই। এটা দেখতে অনেকটা মুভি ক্যামেরার মতো। একজন পুলিশ সদস্য কোনো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গাড়ির গতি ডিটেক্ট বা চিহ্নিত করে সামনের টিমকে ওয়াকিটকির মাধ্যমে অবহিত করে সেই গাড়ির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন দিলে চালক গাড়ি চালানোর সময় সতর্ক থাকবে। কারণ তখন প্রতিটি চালক মনে করবে অতিরিক্ত গতির কারণে যেকোনো সময় তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। তখন সে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাবে না। এ টিমের সাথে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে পারে। মহাসড়কে চালক অপরাধ করলে নগদ জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করতে একটা টিমকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারণ করে দিলে, এরা স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রসিকিউশন দিয়ে নগদ জরিমানা আদায় অব্যাহত রাখলে, চালক বেপরোয়া ও মাত্রাতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাতে সাহস পাবে না। এ েেত্র যে নগদ জরিমানা করা হবে তার ৫০ শতাংশ টাকা ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুরো টিমকে প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হলে পুরো টিম কাজ করতে উৎসাহিত হবে। ফলে ওই কাজে দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না। বাকি ৫০ শতাংশ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা যেতে পারে। এ পদ্ধতি অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিটি জেলায় দু’টি করে টিম কাজ করতে পারে।
আমার ধারণা সারা দেশে মহাসড়কে যদি একযোগে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্পিড ডিটেক্টরের মাধ্যমে স্থান পরিবর্তন করে নগদ জরিমানা আদায় করা চলতে থাকে, তাহলে মাত্র সাত দিনের মধ্যে সারা দেশের রাস্তায় গাড়ি চালানোর শৃঙ্খলা ফিরে আসাসহ জাতি অভিশপ্ত দুর্ঘটনার কবল থেকে রা পাবে। জরুরি ভিত্তিতে ট্রাফিক পুলিশ এবং বিআরটিএ থেকে প্রতিটি চালককে ট্রাফিক আইন ও রোড সাইন বিষয়ে প্রশিণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন), ঝিনাইদহ

No comments

Powered by Blogger.