বঙ্গভবনে মোশতাক ও এরশাদ by এ কে এম শামছুল হক রেণু

ইতিহাস ল করলে দেখা যায়, ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেদনাবিধুর ঐতিহাসিক ঘটনার পর যিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আসন দখল করে ক্যাবিনেট গঠন করেছিলেন, সেই খন্দকার মোশতাক ও তার মন্ত্রিপরিষদের বেশির ভাগই ছিলেন আওয়ামী রাজনৈতিক ঘরানার লোকজন। মোশতাকও ছিলেন একসময় শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী। অপর দিকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে ’৮২-এর ২৪ মার্চ মতা নিয়ে যিনি প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনের মসনদে বসেছিলেন এবং ক্যাবিনেট গঠন করেছিলেন, সেই এ এইচ এম এরশাদও ছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মনোনীত ও নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীপ্রধান। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যেমন বেশির ভাগই আওয়ামী ঘরানার লোক ছিলেন, তেমনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সরদার আমজাদ হোসেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শামসুল হক প্রমুখ। শামসুল হুদা চৌধুরী, ডা: এম এ মতিনসহ অনেকেই ছিলেন জিয়ার বেশ কাছের ও বিএনপির মন্ত্রিসভার সদস্য। অভিজ্ঞজনদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মতানুসারে, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির মসনদে বসার ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক ও এরশাদের চরিত্রকে খণ্ডন করলে তেমন একটা ব্যবধান দৃষ্টিতে আসে না। একজন ছিলেন আওয়ামী ঘরানার ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের খুবই বিশ্বস্ত এবং অপরজন ছিলেন জিয়ার খুবই বিশ্বস্ত। তবে মোশতাক এসেছিলেন রাজনৈতিক পরিসর থেকে, এরশাদ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে। এ প্রসঙ্গে বলা চলে যেই লাউ, সেই কদু এবং যেই আম সেই ম্যাংগো।
শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ব্রিটিশ লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট অ্যান্থনি মাসকারেনাস ও লিফশুলজ রচিত অ খবমধপু ড়ভ ইষড়ড়ফ (রক্তের ঋণ), বাংলাদেশ : আনফিনিশড রেভ্যুলুশন (জেড প্রেস লন্ডন, ১৯৭৯) পুস্তক দু’টিতে দু’জন রাষ্ট্রনায়কের নিহত হওয়ার প্রোপটসহ জেনারেল মঞ্জুর হত্যা, মোশতাক ও এরশাদের মতাগ্রহণ, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দু’জনের শপথ নেয়া ও ক্যাবিনেট গঠনসহ কর্নেল তাহেরেরও ভূমিকা ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রফেসর এমাজউদ্দীনসহ অনেকেরই লেখা পুস্তক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে প্রবাসী হিসেবে বসবাসকারীদের লেখায় শেখ মুজিব ও জিয়ার নিহত হওয়ার প্রসঙ্গসহ খন্দকার মোশতাক ও এরশাদের মতায় আসার ব্যাপারে অনেক কিছু প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবু সাইয়িদের লেখা ফ্যাক্টস অ্যান্ড ডকুমেন্ট পুস্তক থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলোÑ ‘১৯৭৫ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। সিআইএ’র শক্তিধর ব্যক্তিত্ব জর্জ গ্রিফিন তখন কলকাতায়। একটি দল তখন বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে কলকাতায় যায়। গোপনে যোগাযোগ করল গ্রিফিনের সাথে। ওই দলের মধ্যে ছিল মেজর (অব:) ডালিম। দলের অন্যদের সাথে কথা প্রসঙ্গে সে একদিন বলেই ফেলেছে, এ মাসেই আর্মি ক্যু হবে। ঢাকায় ফিরে এসে দলীয় সঙ্গীদের একজন এ কথা বললে, ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ওই দিন রাতে বইটির লেখক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল এম মনসুর আলীকে রিপোর্ট করেন। ১৩ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাাৎ করে বর্তমান বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এসব ব্যাপারে কিছু ইঙ্গিত দিলে (যা বইটিতে উল্লেখ রয়েছে), শেখ মুজিবুর রহমান হাতের ছড়িটি উঁচিয়ে তুলে নাকি বলেছিলেন, টেল ইয়োর ফ্রেন্ডস, আই এম নট অ্যাফ্রেইড।
এ প্রসঙ্গে গত ২৫ আগস্ট একজন কলামিস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত তার কলামে উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার সংবাদ প্রথম পরিবেশন করে মার্কিন বেতারকেন্দ্র ভয়েস অব আমেরিকা (VOA) বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দৈনিক The Washington Post-এর সংবাদদাতা ১৫ আগস্ট দিল্লি থেকে লিখেছিলেন, A military-backed government beleived to favour both Islam and the West took power in Bangladesh today after bloody predawn coup. অর্থাৎ, ‘আজ ঊষালগ্নে বাংলাদেশে একটি রক্তাক্ত উত্থান সংঘটিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি সেনাসমর্থিত সরকার, যার ল্য হলো ইসলামি জীবনব্যবস্থা ও পাশ্চাত্য শক্তির প্রতি অনুরক্তি।’ অন্য একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ২৪ আগস্ট ’৭৫ পর্যন্ত মতায় ছিলেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল তখন ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক। তিনি এক সাাৎকারে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর জিয়াকে এসে বলেন, এখন কী করা প্রয়োজন, জিয়া নাকি তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা হলাম সেনাবাহিনীর লোক। প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট তো বেঁচে আছেন। তিনি এখন প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি আমাদের যে নির্দেশ দেবেন, তাই আমরা করব। জিয়ার নিজের কথায়Ñ President is dead, so what? Vice president is there, you should uphold the sanctity of the constitution. Get your troops ready immediately. জিয়া বিদ্রোহীদের সাথে সহযোগিতা করতে শাফায়াত জামিলকে উপদেশ দেননি; বরং উপরাষ্ট্রপতির আনুগত্যের কথা বলেছেন; যিনি আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষার ওপরও জোর দিয়েছেন। মতা দখল করেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। বঙ্গভবনে মোশতাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ প্রসঙ্গে অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক যখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন, সে অনুষ্ঠানে কর্নেল তাহের উপস্থিত ছিলেন। সামরিক আদালতে বিচারের সময় কর্নেল তাহের যে জবানবন্দী দিয়েছেন, সেখানে উল্লেখ করেছেন, When I reached Bangabhavan at midday, the swearing in ceremony was over. In the evening I sat down with the officers who were involved in the killing. They were headed by Major Rashid. I once again put forward to them the suggestings, I had made to Mushtaque that morning .... During the latter part of our discussion. I called General Zia to joining. (আমি বঙ্গভবনে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর। শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ততক্ষণে। সন্ধ্যায় আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের সাথে বসলাম। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মেজর রশিদ। সকালে মোশতাককে যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সেগুলো আবার উল্লেখ করলাম। আলোচনার শেষপর্যায়ে আমি জেনারেল জিয়াকে আলোচনায় যোগ দিতে ডাকলাম।’ কর্নেল তাহেরের ডাকে সাড়া দিয়ে জেনারেল জিয়া তখন বঙ্গভবনে আসেন কি আসেননি, এ ব্যাপারে লেখাটিতে উল্লেখ ছিল না।
এসব কিছুর পর ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক লিফশুলজ তার পুস্তকে (বাংলাদেশ আনফিনিশড রেভ্যুলুশন) চট্টগ্রামে জেনারেল জিয়াকে হত্যার পর এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য আটক জেনারেল মঞ্জুরকে এরশাদের চালে, কাদের মাধ্যমে কিভাবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হত্যা করা হয়, তা বিশদভাবে বর্ণনাসহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
জাতির দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা এবং প্রত্য মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে অকুতোভয় সিপাহসালারÑ এ দু’জনই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে নিহত হওয়ার পর তাদেরই আষ্টেপৃষ্ঠে দুধকলা খাওয়া ব্যক্তি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আসনে সমাসীন হয়েছিলেন তা জাতির জন্য বাস্তবিকই দুর্ভাগ্যজনক। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে যেন আর কোনো দিন বাংলার ভাগ্যাকাশে এমন ঘটনা না ঘটে, এ দেশের নাগরিক হিসেবে এটাই প্রত্যাশা। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গণতান্ত্রিক ও অহিংস রাজনীতিই হোক সবার কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.