নারকীয়তা বন্ধ হোক by সৈয়দ আবুল মকসুদ

বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনই কারও জন্য পৌষমাস, কারও জন্য সর্বনাশ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আমরা চারদলীয় জোটের দলগুলোর সহিংসতা দেখেছি। তারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং বিশেষভাবে হিন্দুদের ওপর হামলা চালায়। সে এক মারাত্মক সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা। সংখ্যালঘুরা যে শুধু তাদের সম্পদই হারান তা নয়, সম্ভ্রমও হারান তাদের বহু নারী।  দুর্বৃত্তায়িত দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যদি সাম্প্রদায়িক হিংসা-প্রতিহিংসা যোগ হয় তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু ও যে কোনো দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবনে যে কী অভিশাপ নেমে আসতে পারে, গত ৩ দিনে আমরা তা লক্ষ্য করেছি। যশোরের অভয়নগর, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, ঠাকুরগাঁওয়ের গোপালপুর, দিনাজপুরের কর্ণাই, সাতক্ষীরার ক্ষেত্রপাড়া, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, মাগুরার বাটাজোর প্রভৃতি এলাকায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে ব্যাপক অগি্নসংযোগ ও লুটপাট হয়েছে। ওই সব এলাকায় শত শত পরিবারের মানুষ_ শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে দিন-রাতযাপন করছেন। তাদের কান্নায় সেখানকার বাতাস ভারি। এ যে কত বড় বর্বরতা তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এবার আক্রমণের কারণ তারা নির্বাচনে ভোট দিতে গেছেন। আর ভোট যখন দিতেই গেছেন নিশ্চয় নৌকায়ই দেবেন। প্রায় সব জায়গায়ই আক্রমণ চালিয়েছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির ক্যাডাররাও থাকতে পারে।
ওই সব লোকালয়ের নিম্নবিত্ত মানুষের অপরাধ, তারা ভোট দিতে গেলেন কেন? ভোট দেওয়া বা না দেওয়া প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত মর্জি ও সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার। সে জন্য কেউ কোনো সভ্য সমাজে নির্যাতন বা এ জাতীয় নারকীয়তার শিকার হতে পারেন না।
দুর্গত এলাকা থেকে যেসব সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়, শুধু নির্বাচনবিরোধীরাই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারী নয়, যেসব মহাজোটের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন তাদের কর্মী বাহিনীও এ জাতীয় বর্বরতায় অংশ নিয়েছে অথবা মদদ জুগিয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে সম্ভাব্য গোলযোগ হতে পারে সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব। এবার চার লাখের বেশি নিরাপত্তা কর্মী নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও হিন্দু পাড়াগুলোতে এমন নারকীয়তা হতে পারে কীভাবে? মহাজোটের নেতাকর্মীরাই-বা কোথায় ছিলেন?
জামায়াত-শিবিরের হুঙ্কার সত্ত্বেও প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে। সরকার তার দলীয় কর্মীদেরও সতর্ক করে নিয়োজিত রাখেনি। সুতরাং এ জঘন্য অপরাধের দায় তারা এড়াতে পারেন না।
আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুষ্কৃতকারীদের কঠোরতম শাস্তি চাই। অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা চাই। শুধু নগদ কিছু খয়রাতি নয়, সর্বস্ব হারানো মানুষের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দিতে হবে। যাদের দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠিত হয়েছে তাদের বিনা সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো_ সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যাতে এ জাতীয় নারকীয়তা আর কখনও না ঘটে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও বুদ্ধিজীবী

No comments

Powered by Blogger.