কঠোর হস্তে দমন করুন by আবু সাঈদ খান

এ কোন বর্বরতা! এ কোন অসভ্যতা! একের পর এক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে, তারা ঘরছাড়া হচ্ছেন, দেশছাড়া হচ্ছেন। নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানের হিন্দু জনগোষ্ঠী দুর্বৃত্তের হামলার শিকার। টেলিভিশনের পর্দায় আতঙ্কিত শিশুর মুখ দেখছি। ভয়ার্ত নারীর আর্তনাদ শুনছি। এই কি সেই বাংলাদেশ, যে দেশের জন্য লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন। দেশে মানবতা আজ পদদলিত। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত। নতুন করে সংঘটিত হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ। স্বাধীনতার চার দশক পর আমরা কী দেখছি? সাম্প্রদায়িক শক্তি বিভিন্ন অজুহাতে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নর-নারীর ওপর হামলা করছে, বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে ভাংচুর করছে, আগুন দিচ্ছে। সংখ্যালঘুরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। নির্বাচনের পর যশোর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিত হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। কারণ হিসেবে যেটি জানা যাচ্ছে, বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করার পরও তারা কেন ভোট দিয়েছে। হিন্দুরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাই তাদের শিক্ষা দিতে হবে, দেশছাড়া করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের বক্তব্য, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের বয়ানে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রধানত জামায়াত-শিবির, কোথাও কোথাও বিএনপির কর্মীরা এই অপকর্মের হোতা। কিছু বিভ্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকও উৎসাহ নিয়ে এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ইতিপূর্বে রামুতে সংঘটিত বৌদ্ধপল্লীর হামলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের মুখ্য ভূমিকায় দেখা গেছে। পাবনার সাঁথিয়াতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর লোকজন জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যতদূর জানা যায়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদের সভায় যোগ দেওয়ার কারণে প্রতিমন্ত্রীর লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে এ অপকর্ম সংঘটিত করে। এর প্রতিদানও মিলেছে। সারাদেশে জামায়াত-শিবির নির্বাচন বর্জন করলেও ওই এলাকায় জামায়াত-শিবিরের স্থানীয় নেতাকর্মীরা টুকু সাহেবের জন্য ক্যাম্পেইন করেছে বলে শোনা গেছে।
নির্বাচন-উত্তর সংঘটিত সহিংস ঘটনার দায় কেবল জামায়াত-শিবিরই নয়, এ দায় প্রধান বিরোধী দলের ওপরও বর্তায়। অনেক স্থানে বিএনপির কর্মীরা হামলায় অংশ নিয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, জামায়াত-শিবির বিএনপির ছত্রছায়ায় এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত হাত ধরাধরি করে চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে বিএনপি কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। দলের নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে পুলিশি ভূমিকার নিন্দা করছেন, নিহত দুর্বৃত্তদের জন্য সহানুভূতি জানাচ্ছেন। অথচ নিরপরাধ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ব্যাপারে কিছুই বলছেন না। বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে এটিকে সরকারের ষড়যন্ত্র বলে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ কাজে যেন তাদের অনুমোদন রয়েছে! অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্রতিকারের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। হয়তো ভাবছে যে, বিরোধীদের এ অপকর্ম তাদের রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণার পুঁজিতে পরিণত হবে।
অভয়নগরের চাপাতলার ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, এক ঘণ্টা আগে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের জানানো হয়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। রাজনৈতিক দল হিসেবে কি এটি আওয়ামী লীগের কর্তব্য নয়? সামাজিক প্রতিরোধের যে ঐতিহ্য ছিল _সেটিও থিতিয়ে গেছে। এসব অপশক্তির মোকাবেলা করা রাজনৈতিক দলগুলোর তো বটেই, জনগণেরও এগিয়ে আসা কর্তব্য।
হিন্দুদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, হয়তো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় তারা জামায়াত-শিবির ও বিএনপির টার্গেটে পরিণত হয়েছে। সেই আওয়ামী লীগও তাদের পাশে নেই। কখনও কখনও আওয়ামী লীগ কর্মীদের থাবায় তাদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে।
পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি আমাদের বিস্মিত করে। নির্বাচন উপলক্ষে সারাদেশে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি-সেনাসদস্যরা মোতায়েন রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতেও সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ রামুতে উঠেছিল। তা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। যশোরের অভয়নগরেও পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। এসব খতিয়ে দেখা দরকার, অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।
এটি সত্য যে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্তের কাজ। এর সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে এর পেছনে কতিপয় রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ আছে। এ অপরাধের মূলোৎপাটন করতে হলে সেসব কারণ পর্যালোচনার দাবি রাখে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপিত হলেও সমাজ ও রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না। বরং হীন স্বার্থে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের চর্চা হচ্ছে। ফলে ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো তো বটেই, এর বাইরের দল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি প্রভৃতি দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বাসা বেঁধেছে। অনেকেই পাকিস্তান আমলের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে গণ্য করছে। এর বাইরে রয়েছে সমাজের দুর্জনদের লোভাতুর দৃষ্টি। তারা অপেক্ষায় আছে_ কবে, কত জলদি হিন্দুরা দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবে। আর তারা সুলভ মূল্যে হিন্দুদের বাড়িঘর, পুকুর, জমি খরিদ করতে পারবে। যে কারণে এই দুর্জনরা অপকর্মে মদদ দিচ্ছে। এসব রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে সংখ্যালঘুদের জন্য দেশটি ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ চেতনায় অসাম্প্রদায়িক। হাজার বছর ধরে সুফি-বৈষ্ণব-ভিক্ষু-পাদ্রি-বাউলরা এখানে মানবিক চেতনা লালন করে আসছেন। চণ্ডীদাস-লালন-মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুলের মানবপ্রেম ও সাম্যের গানে মানুষ সদা উদ্দীপ্ত হচ্ছে। লাখো শহীদের রক্তস্নাত এ দেশ। হক-ভাসানী-মুজিব-তাজউদ্দীনের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। এমন কর্ষিত মানবজমিনে সাম্প্রদায়িক বর্বরতা ঘটবে, সংখ্যালঘুরা আর্তনাদ করবে_ তা কি মেনে নেওয়া যায়?
বাংলাদেশের সংবিধানে আছে_ দেশের মালিক জনগণ। এর মানে এই যে, মুসলমানরা ধর্মীয় দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানে মুসলমান নর-নারীর যতটুকু অধিকার, সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নর-নারীর ততটুকু অধিকার। এ কথা জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সত্য। আমাদের সংবিধানের মর্মবাণী হচ্ছে_ বাংলাদেশে সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষের সমঅধিকারের দেশ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর ধারণা দেওয়া হয়েছিল, এটি মুসলমানের দেশ। সেই অনুযায়ী পাকিস্তানের সংবিধানও প্রণীত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সেটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র। 'মুসলমানের দেশে' সংখ্যালঘুদের করা হয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সে সময় একাধিক দাঙ্গা বাধিয়ে হিন্দু বিতাড়ন ও নিধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ একাত্তরে ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার নামে হিন্দু নিধন চলেছিল। হিন্দুরা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পয়লা টার্গেট। একাত্তরে লাখো শহীদের লাশের তলায় সেই দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তানের কবর হয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানি ভূত এখন বাংলাদেশে আছর করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশকে কি আমরা মিনি পাকিস্তান বানাব, না বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব? আর রুখে দাঁড়াতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সবধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নির্মূল করতে জাতিকে একাত্তরের চেতনায় ফিরে যেতে হবে। মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী রাজনীতি কঠোর হস্তে দমনের পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে দেশ পরিচালনা করতে হবে, সেই সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন একাত্তরের চেতনায় নবজাগরণ, নবউত্থান।
সরকার-প্রশাসনের একান্ত কর্তব্য হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রধানমন্ত্রী 'জিরো টলারেন্সের' কথা বলছেন। সেই লক্ষণ আমরা দেখছি না। আমরা এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানাই। এ ক্ষেত্রে নমনীয়তার সুযোগ নেই। সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার করাই হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক মতানৈক্যের ঊধর্ে্ব আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল ও মতের মানুষ ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্যে পেঁৗছবে_ সেটিই প্রত্যাশিত।
সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.