কান পাতলেই ক্ষোভ শোনা যায় by সঞ্জয় কুমার

'এ দেশে কী ঘটছে আমি জানি না। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াতে সমস্যার মুখোমখি হচ্ছি। এ নিয়ে আমি খুবই বিচলিত', বললেন ইমরান হক নামে বাংলাদেশের এক দিনমজুর। ঢাকার শহরতলি সাভারের দোকানদার আমানউল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'আমি আমার দোকান খোলা রাখতে চাই, কিন্তু দোকান বন্ধ না রাখলেই বিক্ষোভকারীদের হাতে আক্রান্ত হতে পারি_ এই ভয় আমার মধ্যে কাজ করে। স্বাভাবিক জীবনযাপন আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাসে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।'
এসব দিনে ঢাকার রাজপথে কান পাতলেই ক্ষোভ ও হতাশা ভেসে আসবে। শেখ হাসিনার বাড়ির মনমেজাজ কিন্তু ভিন্ন। শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী মানসিকতায় রয়েছে এবং সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর তাদের প্রতি জনসমর্থন রয়েছে বলে মনে করছে। রীতিমাফিক নির্বাচনের ফলাফলের পর ডাকা সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আস্থাশীল মনে হয়েছে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে তিনি তেমন একটা আমলেই নিতে চাননি। সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলবিহীন একটি সংসদ কীভাবে বৈধতা পেতে পারে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির দায় প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপান।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে ১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ হারানোয় তাদের জোটসঙ্গী বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। এর অর্থ এই নয় যে, নির্বাচন বৈধতা পায়নি। জনগণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছে এটাই বৈধতার মাপকাঠি। এ ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও ছিল। সুতরাং এখানে বৈধতার প্রশ্ন আসার কোনো সুযোগ নেই। আরেকটি নির্বাচনের সম্ভাবনার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান বিষয়টি একেবারে খারিজ করে দেননি। তবে তিনি বলেন, নির্বাচন হবে কি হবে না সেটা সম্পূর্ণত নির্ভর করছে বিরোধী দল বিএনপির মনোভাবের ওপর।
শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করার পরও প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আমি তাদের বলেছিলাম, তারা নির্বাচনে এলে আমি সব দলের সদস্যদের নিয়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে রাজি। নির্বাচনে আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা যে যে মন্ত্রণালয় চান, সে সে মন্ত্রণালয়ই তাদের দেওয়ার কথা বলা হয়।
তিনি বলেন, 'তারা নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টাও করেছেন এবং উল্টো তারা সন্ত্রাসবাদী জামায়াতের সহায়তায় হরতাল ও সহিংসতা চাপিয়ে দিয়েছেন। হাসিনা আরও বলেন, 'বিএনপি নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। তারা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নির্বাচন আদৌ হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে বিরোধীদের মনোভাবের ওপর। তারা কী করে, কী করছে এসব দেখতে হবে। সময় এলে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।' তবে শেখ হাসিনার মন্তব্য বিস্তৃত প্রেক্ষিতে বিচার করলে, বিরোধী দল হরতাল ও সহিংসতার পথ ত্যাগ করলে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া দেখা যায়নি, বরং তাকে আগের মতোই আস্থাশীল মনে হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা কেউ বাইরের মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নন বলেই মনে হয়েছে।
বিএনপি লাগাতার জনবিচ্ছিন্ন হরতাল-অবরোধ দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের একদিন পর সোমবার পুনরায় তারা হরতাল ডাকে। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এ ধরনের কর্মসূচিতে ৩০০'রও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে_এই বাস্তবতায় তারা বিস্মৃত নয়। বিরোধীদের নৃশংসতাই অধিকাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার কি সংসদে তাদের চারভাগের তিনভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও কার্যকরভাবে দেশ শাসনে সক্ষম হবে? কিন্তু নির্বাচনে এই বিরাট সাফল্য দেশে স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি নয়। নির্বাচনের আগে যেমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ছিল, নির্বাচনের পরও তার ইতরবিশেষ হয়নি। বিএনপি এবং তার জোটসঙ্গীরা হরতাল-অবরোধ ডেকেই চলেছে। এভাবে তারা কার্যত দেশকে অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল ইসলামের মতে, অনুুষ্ঠিত নির্বাচনটি অর্থহীন। দেশকে এ ধরনের সংকটে নিমজ্জিত করার জন্য সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই দায়ী করা চলে। দি ডিপ্লোমেটের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি দুই প্রধান দলের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেন। তার এ বক্তব্য বিএনপি নেতারাও অস্বীকার করেননি।
সিনিয়র বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু এ জন্য শাসক দলকে কিছুটা নমনীয়তা দেখাতে হবে, এ মুহূর্তে সেটা দৃশ্যমান নয়। দেশে এখন যে সংকট চলছে তার জন্য আমাদের দায়ী করা চলে না। বাংলাদেশের ডেইলি স্টার পত্রিকা অচলাবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করেছে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন না বলেও পত্রিকাটি বলেছে। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রী জোরের সঙ্গে এই নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলছেন; কিন্তু এতে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কাটবে না। তার মন্তব্য রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা কাটানোর ক্ষেত্রে হতাশাজনক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারের কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটি আপস-রফায় পেঁৗছতে পারেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় যারা হত্যা, ধর্ষণসহ নানা যুদ্ধাপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় চার বছর আগে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিহাব সুমন মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশে একটি অত্যন্ত আবেগঘন বিষয়। লাখ লাখ মানুষ ওই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তখন কতিপয় গ্রুপ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। মানুষ চায় এদের শাস্তি হোক। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে দুই প্রধান বিরোধী দলের বিরোধ চরমে ওঠে। এ কারণেই খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে আসার জন্য অনেক সাধাসাধি করার পরও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলার সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করায় হাসিনার প্রশংসা করেছেন। এটা বিএনপির স্বার্থের অনুকূল এবং আওয়ামী লীগের বিচার সম্পন্ন করে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা। তখন বিএনপি ক্ষমতায় এলেও এই ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের গ্রেফতারকৃত নেতাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য জামায়াত বিএনপির ওপর চাপ দিতে পারবে না। ডেইলি স্টারের মতে, যারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ও অগণতান্ত্রিক বলা সঠিক নয়। পত্রিকাটির ভাষ্য হচ্ছে, তারা মনে করে না, যে ৭০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যায়নি তারা স্বাধীনতাবিরোধী। নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের জন্য স্বস্তি বয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু পপুলার ম্যান্ডেট ছাড়া নির্বাচনী ফলাফল সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ঘরে বদ্ধ থাকা কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। এখন একমাত্র আশা হলো সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক পরিসরে নতুন নির্বাচন।
ভাষান্তরিত
জাপানভিত্তিক দি ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার দিলি্ল প্রতিনিধি

No comments

Powered by Blogger.