ধ্বংসস্তূপে চাপা কান্না

আক্রান্ত-সর্বস্বহারা মানুষগুলো ঘরে ফিরলেও মালোপাড়ায় নেই আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য। শিশুদের কলকাকলি থেমে আছে এখনও। সব হারিয়ে স্তব্ধ পুরো গ্রাম। যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলার ওই গ্রামে সন্ধ্যা নামার আগেই নারী-শিশুদের অনেকে পাড়ি জমাচ্ছে নদীর ওপারে। যারা থাকছেন, তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। ভোট দিতে যাওয়ায় ৫ জানুয়ারি এই গ্রামে তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির। এর পর সেখানে প্রশাসনের সার্বক্ষণিক নজরদারি। এক কিলোমিটারের মধ্যে বসানো হয়েছে দুটি পুলিশ ক্যাম্প, যেখানে অবস্থান করছে অস্ত্রধারী ৭০ জন ফোর্স। আসামিদের ধরতে পুলিশ চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। দু'দিনে ২৬ জনকে আটক করা হয়েছে। নেতারাও আসছেন-যাচ্ছেন সারাদিন। তার পরও আশ্বস্ত হতে পারছে না মালোপাড়ার সংখ্যালঘুরা। মালোপাড়ার শতাধিক পরিবারে এখনও বোবা কান্না আর চাপা আতঙ্ক।
বুধবার মালোপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরবাড়ির ভাঙাচোরা উপকরণ, পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ। এলাকার নারী-পুরুষ সবার চোখেমুখে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। তাদের এখনও তাড়া করে ফিরছে নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া নারকীয় তা বের স্মৃতি। তা বের শিকার মায়া রানী বর্মণ জানান, রাস্তার পাশে তার টিনের খুপরিঘরে কিছু নেই। ঘর ভেঙেচুরে তছনছ করে জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে হামলাকারীরা। তিনি জানান, লাঠিসোটা, রামদা, বোমা, ইটপাটকেল নিয়ে দুর্বৃত্তরা তা ব চালিয়েছে।
প্রশাসনের তৎপরতা ও পদক্ষেপে আশ্বস্ত হয়ে ওই পাড়ার ৭০০ নারী-পুরুষ এলাকায় ফিরলেও রাত নামার আগেই গ্রাম ছেড়ে ওপারে আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে। এ গ্রামের বাসিন্দা তরুণ বিশ্বাস আলাপকালে বললেন, 'এলাকার সব কারেন্টের লাইন (বৈদ্যুতিক তার) কেটে দিয়ে দুই দিক দিয়ে হামলা চালায় জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা। সেই লাইন এখনও ঠিক হয়নি। তাই সইন্ধ্যেই অন্ধকার হয়ে আসলিই ভয় বাইড়ে যায়। এই জন্যি পাড়ার মহিলারা এখনও রাত্তিরি বাড়ি থাকতিছে না। আর ভয়-আতঙ্কে আছি আমরাও।'
মিল শ্রমিক গণেশ সরকার জানান, মালোপাড়া আজও বিদ্যুৎবিহীন। তবে প্রায় সব বাড়িতেই অন্য পাড়া থেকে সাইডলাইন নেওয়া হয়েছে। ঘরের দরজা-জানালা এখনও ভাঙা। তাই রাতে নারীরা গ্রামে থাকছেন না। অনেকেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেছেন, আবার অনেকেই নদীর ওপারে চলে যাচ্ছেন। সন্ধ্যায় গিয়ে সকালে গ্রামে ফিরছেন। দুর্গা রানী নামের এক নারী জানান, ঘটনার পর থেকে বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছেন তার তিন পুত্রবধূ। পাশের বাড়ির দুলাল বিশ্বাস তার স্ত্রী ও অনার্সপড়ূয়া মেয়ে অনিতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও এখনও ফেরেনি তার কিশোরী তিন মেয়ে মঙ্গলী, নিতু ও নিপা।
যারা গ্রামে ফিরেছেন এবং রাতও কাটাচ্ছেন, এখানে তাদের অবস্থা আরও করুণ। গৃহবধূ যমুনা বিশ্বাস জানান, প্রশাসনের সহায়তায় দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে গ্রামে ফেরার পর রাত কাটাচ্ছেন বাড়িতেই। কিন্তু সারারাত ছেলে স্বপ্ন ও সুদীপ্তকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে হচ্ছে। কারণ, কিছুক্ষণ পর পর ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠছে তারা। ঘটনার দিন অবুঝ ওই দুই ছেলের সামনেই বাবা শ্যামল বিশ্বাসকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। এর পর থেকেই এমন করছে বাচ্চারা।
গতকাল দুপুরে মালোপাড়া পরিদর্শনে যান যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান ও পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র ও নগদ অর্থ বিতরণ করেন। এ সময় পুলিশ সুপার জয়দেব ভদ্র জানান, এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও হামলায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের সর্বোচ্চ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। মালোপাড়া ও চেঙ্গুটিয়ায় দুটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। চেঙ্গুটিয়া ক্যাম্প ইতিমধ্যে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে। দু'দিনে ২৬ জনকে আটক করা হয়েছে।
যশোরের জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মালোপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নিরাপত্তাসহ তাদের সব ধরনের সহযোগিতার দায়িত্ব সরকারের। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে করণীয় সবকিছুই অব্যাহত রেখেছে। যতদিন প্রয়োজন হবে, প্রশাসন তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাবে। তবে গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কাজকর্মের জন্য সারাদিন থাকেন বাইরে বাইরে। বাড়ি ফিরতেও হয় গভীর রাত। দু-একজনের আবাদি জমি রয়েছে অন্যত্র। কিন্তু ভয়ে তারা যেতে পারছেন না গ্রামের বাইরে। ফলে চাষবাস, কাজকর্ম সবই বন্ধ। দুর্বৃত্তদের পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা ভেঙে ফেলা ঘরবাড়ি সংস্কার তো দূরের কথা, সংসার চালাবেন কীভাবে তা নিয়েই চিন্তিত তারা। রোববার নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা পরই অভয়নগর উপজেলার এই মালোপাড়ায় জামায়াত-শিবিরের কয়েকশ' ক্যাডার ব্যাপক তা ব ও লুটপাট চালায়। ৮/১০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তারা শতাধিক বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করে। হামলার সময় প্রাণ নিয়ে প্রায় ৬০০ নারী-পুরুষ গ্রাম ছেড়ে নদী পার হয়ে পাশের দেয়াপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন।

No comments

Powered by Blogger.