আসুন, আক্রান্তের পাশে দাঁড়াই

রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন বা ভোট এলেই সংখ্যালঘুদের ওপর নানা রকম নির্যাতন-নিগ্রহ নেমে আসে। রাজনৈতিক দলগুলো যার যার সুবিধামতো সংখ্যালঘুদের ব্যবহার করে। সারা দেশে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভোটদানে বিরত রাখার যড়যন্ত্র করা হয়। এ কারণে সংখ্যালঘুরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে সীমাহীন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। অনেক স্থানে ভোটের আগে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য সংখ্যালঘুদের হুমকি দেওয়া হয়। আবার অনেক স্থানে সরাসরি সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর হামলা করা হয়। এবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এর নির্বাচনেও কিছু কিছু এলাকায় সংখ্যালঘুদের ভোটদানে প্রতিবন্ধকতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০০১-এ দেখা গেছে একেবারে ভিন্ন চিত্র। ২০০১-এর ঘটনাগুলো পরিচালিত হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনামাফিক।
২০০১-এর অক্টোবরের নির্বাচনের অব্যবহিত পরে দেশে সংখ্যালঘু নিধন ও নির্যাতনযজ্ঞের এক ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে নিন্দা জানিয়েছিল সারা বিশ্ব। ২০০৮-এর নির্বাচনেও এ দেশের সংখ্যালঘুরা কমবেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই পাবনা, বরিশাল, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ভিটেছাড়া করা হয়েছে। মানবসেবী ও সুশীল সমাজের কিছু মানুষ শুধু তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন বিকেলে আবারও সাম্প্রদায়িক শক্তি অসহায় সংখ্যালঘু মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় সংখ্যালঘুদের ১৩০টি বাড়ি ভাঙচুর ও ১২টি পুড়িয়ে দেওয়া হয় (৬ জানুয়ারি, প্রথম আলো)। প্রাণভয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে গেছে অধিকাংশ গ্রামবাসী। নির্বাচনের সহিংসতা এখানেই থেমে যায়নি; পরদিন আবার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অপরাধে দিনাজপুরের চেহেলগাজী ইউনিয়নে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভেঙে ধ্বংস করা হলো দুই শতাধিক দোকান ও বাড়িঘর। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে গতকালও। আমরা পত্রিকায় পড়েছি, টিভিতে দেখেছি হাজার খানেক সংখ্যালঘুর উদ্বিগ্ন মুখ, যারা ঠাকুরগাঁওয়ের গোপালপুরের আবাস ছেড়ে নিরাপত্তার জন্য ইসকন মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। সাতক্ষীরার তালা, কলারোয়া এবং যশোরের বিজয়রামপুরেও একই চিত্র।
সব মিলিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘু জনগণকে। এবারের নির্বাচন তাদের জন্য ছিল উভয়সংকট। একদিকে নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ, অন্যদিকে ভোট দিলে সাম্প্রদায়িক জামায়াত-শিবিরনিয়ন্ত্রিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যানকারী ১৮ দলের আক্রমণ। ভোট দেওয়ার অধিকার দেশের প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার। আমাদের সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ তার এই ক্ষমতা ব্যবহার করে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এই ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না। কারণ, ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। তাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কাউকে অন্যায়ভাবে প্ররোচিত বা বাধ্য করা কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ভোটদান থেকে বিরত রাখার হীন উদ্দেশ্য আমাদের দেশের আইনের পরিপন্থী এবং সংবিধানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারসংক্রান্ত দলিলের লঙ্ঘন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত এবং নির্বাচনে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের প্রতিফলন ঘটা প্রয়োজন। কিছুসংখ্যক লোকের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে বর্বরোচিত নির্যাতন করার রীতি চলছে, তা তাদের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে হরণ করে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র,
যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু নির্যাতনের আলামত দেখা গিয়েছিল। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে দেশের প্রত্যেক মানুষ যেন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধানের অঙ্গীকার করেছিল সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সে অঙ্গীকার রক্ষিত হয়নি অপশক্তির দাপটের কারণে। বিশেষ করে মৌলবাদী জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বিভিন্ন স্থানে বোমা মেরে, বাসে আগুন দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এই অবস্থায় দেশের সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের দায়িত্ব, আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আর সরকারের দায়িত্ব হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, সেটি কারোরই কাম্য নয়। এখনই সময় এসেছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষদাঁত ভেঙে দেওয়ার।
আসুন, আমরা আক্রান্তের পাশে দাঁড়াই এবং আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.