বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ বক্তৃতা দেন মুজাহিদ by কুন্তল রায়

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ঢাকার আরেক প্রান্তে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন।
তিনি বদর বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁর রায়ে এসব তথ্য দিয়েছেন। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল গত বুধবার মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) ছিল আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইটি উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজাকার বাহিনীর প্রধান ও শান্তি কমিটির লিয়াজোঁ কর্মকর্তাকে নিয়ে জামায়াতের আমির গোলাম আযম মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে যে রাজাকার ও আলবদর শিবির পরিদর্শন করেছিলেন, সেটিই ছিল আলবদরদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগকে আলবদররা প্রথমে চোখ বেঁধে এখানে নিয়ে আসে। নির্যাতনের পর এখান থেকে তাঁদের রায়েরবাজারে ও মিরপুরের শিয়ালবাড়িসহ অন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের জামায়াত নেতা সেলিম মনসুর খালেদের লেখা আল-বদর নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। উর্দু ভাষায় লিখিত ওই বইয়ের ১৭৬-১৭৮ পৃষ্ঠায় সেলিম মনসুর লেখেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্র সংঘের নাজিম (অর্থাৎ সভাপতি) নির্যাতনকেন্দ্র বলে পরিচিত মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে ‘আখেরি খিতাব’ (শেষ বক্তৃতা) দেন। বক্তব্যে তিনি দিনটিকে (বাংলাদেশের বিজয় দিবস) ‘বেদনাদায়ক দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণকে বলে ‘ট্র্যাজেডি’। সেদিন মুজাহিদ আরও বলেন, ‘আমরা বিগত দিনগুলোর জন্য লজ্জিত নই। আর সামনের দিনগুলোর জন্য নিরাশও নই।’ শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বন্ধুরা! আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান।’ এরপর আলবদর সদস্যরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান।
রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। একাত্তরের ১৯ ডিসেম্বর ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম, টিভি ও রেডিওর প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ শেষে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজের কয়েকটি কক্ষে গিয়ে রক্তের স্রোতধারা দেখতে পান। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রগুলো। এতে প্রমাণিত হয়, ওই কলেজটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি হত্যাপুরী, আর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আসামি মুজাহিদ সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পুণ্য রক্ত মাড়িয়ে আলবদর সদস্যদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদরের সদর দপ্তর ও নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আরও অনেক তথ্য তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনাল। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী ও শারীরিক শিক্ষা কলেজের নিরাপত্তাকর্মী রুস্তম আলী মোল্লা একাত্তরে ওই কলেজ-সংলগ্ন আবাসিক এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। স্বাভাবিকভাবে ওই স্থানে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি ওই নির্যাতন ক্যাম্পে জামায়াত ও ছাত্র সংঘের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মুজাহিদকে দেখেছেন। এ জন্য তিনি এ বিষয়ে একজন উপযুক্ত সাক্ষী।
রুস্তম আলীর দেওয়া সাক্ষ্য উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, বিজয়ের সাত-আট দিন আগে আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা ওই ক্যাম্পে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কলেজের পেছনে একটি ইটভাটায় শতাধিক চোখ স্তূপ করা অবস্থায় দেখেন। ১৭ ডিসেম্বর তিনি কলেজের জিমনেসিয়ামে (ব্যায়ামাগার) নয়টি ভাঙাচোরা খুলি দেখতে পান। জেরায় আসামিপক্ষ এসব বিষয়ের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় বইতে বলা হয়েছে, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য আলবদররা ব্যাপকভাবে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করা শুরু করে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে। কারফিউ এবং ব্ল্যাক আউটের মধ্যে জিপে করে আলবদরা দিন-রাত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রথমে তাদের কাদামাখানো একটি বাসে তোলে। এরপর বাসবোঝাই বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের বন্দীকে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে আলবদর সদর দপ্তরে নিয়ে নির্যাতন করে।
রায়ে আরও বলা হয়, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম আযম ১৭ সেপ্টেম্বর শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে রাজাকারদের উৎসাহ জোগাতে বক্তৃতা করেন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই কলেজটি শুধু রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল না, বরং একাত্তরে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করার স্থান ছিল।
ট্রাইব্যুনাল ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক পাকিস্তান-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেন। তাতে বলা হয়, বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করার জন্য বাংলার জঘন্যতম শত্রু ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামী যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আলবদর নামে জল্লাদ বাহিনী গঠন করেছিল, তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে। ওই জল্লাদদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত লালমাটিয়ার শরীরচর্চাকেন্দ্র থেকে উদ্ধার করা এসব তথ্যে বদর জল্লাদদের আরও কয়েকজনের নাম-পরিচয় ও ঠিকানা পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ সংবাদ শুনতে আপনার মোবাইল ফোন থেকে ডায়াল করুন ২২২১

No comments

Powered by Blogger.