ছায়া সুনিবিড় হুমায়ূনতীর্থ by নওশাদ জামিল

'ওই যে দেখছেন তিনটা লিচুগাছ- ওই জায়গাটাই স্যারের খুব প্রিয় ছিল।' কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল। তিনি জানান, নুহাশপল্লীতে এলে হুমায়ূন আহমেদ প্রথমেই খোঁজ নিতেন গাছপালার।
কোন গাছে ফুল এলো, কোন গাছে ফল, কোনোটার রোগ-বালাই হলো কি না কিংবা কোথাও আগাছা জন্মাল কি না- সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন তিনি।
ছায়াঢাকা যে জায়গাটা দেখালেন সাইফুল ইসলাম তার এক পাশে তিনটি মাঝারি আকারের লিচুগাছ, অন্য পাশে সারি সারি আম, জাম, লটকনসহ নানা জাতের গাছগাছালি। নুহাশপল্লীর ফটক থেকে ২০০ গজ উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এ জায়গার নামই 'লিচুতলা'। পাশেই বেশ কয়েকটি জাম, জলপাই ও তেঁতুলগাছ। গাছগুলোর মাঝখানে একখণ্ড ফাঁকা জায়গা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। দক্ষিণে শেফালি, কামিনী ফুলসহ অন্যান্য গাছ। তিনটি লিচুগাছের গোড়া বাঁধানো। সেখানেই তিনি বসে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে যেতেন বাংলোয়।
নুহাশপল্লীর ওই লিচুতলায় সমাহিত করা হয় বাংলা সাহিত্যের এ বরেণ্য কথাশিল্পীকে। পরবর্তী সময়ে এ নুহাশপল্লী পরিণত হয় হুমায়ূনতীর্থে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিনই এখানে ঘুরতে আসেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগী ও পাঠকরা। লিচুতলার এ ছায়াঢাকা নিভৃতপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের কবরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি নান্দনিক সমাধিফলক। কবর বাঁধানো হয়েছে ধবধবে শ্বেতপাথরে। বাঁধানো এপিটাফে লেখা, 'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে/নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে'। লেখকের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন কালের কণ্ঠকে জানান, লেখকের ইচ্ছানুসারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ছত্র পঙক্তি লেখা হয়েছে এপিটাফে।
শেষের দিককার আত্মজৈবনিক রচনা 'কাঠপেন্সিল' শীর্ষক বইয়ে লেখক নিজের এপিটাফ কী হবে, তা নিজেই লিখে যান। বইটির 'অসুখ' নামক একটি অধ্যায়েও তাঁর এই চিন্তার প্রকাশ ঘটেছিল। তিনি লিখেছেন, "আমার উচিত, কাগজ-কলম নিয়ে এপিটাফ লিখে ফেলা। কল্পনায় দেখছি, নুহাশপল্লীর সবুজের মধ্যে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবর। তার গায়ে লেখা, 'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে/নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে'।" (কাঠপেন্সিল, পৃষ্ঠা-৭৫)
সুযোগ পেলেই এখানে আসতেন নিসর্গপ্রেমী এই নন্দিত কথাশিল্পী। অসুস্থতার মধ্যে গত বছর ১১ মে বাংলাদেশে ফিরে ২১টি দিনের আট দিন তিনি সপরিবারে কাটিয়েছেন এই নুহাশপল্লীর গাছপালা আর পাখপাখালির সঙ্গে। বিমানবন্দর থেকেই তিনি সোজা চলে যান প্রিয় নুহাশপল্লীতে। পাখিরা লিচুগাছের পাকা লিচু ঠুকরে খাচ্ছে। তদারককারীরা এসে বলছেন, 'স্যার, লিচু তো খেয়ে ফেলছে পাখি। জাল দিয়ে ঘিরে দেব?' হুমায়ূন আহমেদ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, 'একটার ফল পাখিরা খাচ্ছে খাক। একটায় জাল দাও, আর একটা পাখিদের জন্য খোলা থাক।' কারণ পাখিরাও নুহাশপল্লীর ফলের হকদার- এমনই ভাবতেন তিনি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে হোতাপাড়া বাজার। বাজার থেকে পশ্চিমে আট কিলোমিটার দূরে পিরুজালী গ্রাম। ১৯৯৭ সালে পিরুজালীতে ৪০ বিঘা জমিতে বড় ছেলে নুহাশের নামে 'নুহাশপল্লী' গড়ে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। এখানে তিনি দুর্লভ ২৫০ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। এ ছাড়া হাঁস, রাজহাঁস, গরু, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণী এখানে রয়েছে। এই নুহাশপল্লীতেই হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছেন শুটিং স্পট, দিঘি, তিনটি সুদৃশ্য বাংলো আর অনেক ভাস্কর্য। দিঘিটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের গর্ভে মৃত মেয়ে লীলাবতীর নামে। বিশাল দিঘির ওপর রয়েছে একটি কাঠের সেতু। দিঘির মাঝখানে ছোট্ট দ্বীপ।
নুহাশপল্লীতে রয়েছে বিশাল এক ঔষধি গাছের বাগান। সেটির নামকরণ করেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের গর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত শিশুপুত্র রাশেদ হুমায়ূনের নামে। তিনটি বাংলোর একটির নাম 'বৃষ্টিবিলাস'। ওপরে টিনের চাল। বৃষ্টির দিনে এখানে তিনি শুনতেন বৃষ্টির নূপুর। দিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি বাংলোর নাম 'ভূতবিলাস'। অন্য বাংলোটিতে থাকতেন তিনি। সেটি কর্মচারীদের কাছে স্যারের বাংলো নামে পরিচিত।
সবুজ নিসর্গ, পাখপাখালি আর নুহাশপল্লীর কর্মচারীরা এখন অভিভাবকহীন। এক বছরেও কাটেনি শোক ও ব্যথার দহন। মনে হয় প্রাণহীন দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক পাথরের ভাস্কর্য মা ও শিশু, রাক্ষস, ডাইনোসর, শালিক, মৎস্যকন্যা- সবার মধ্যে যেন ছড়িয়ে আছে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা।
১৯৯৭ সালে অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলামের সহযোগিতা আর উৎসাহে হুমায়ূন আহমেদ এখানে জমি কিনে গড়ে তোলেন নুহাশপল্লী। অখ্যাত দূর জনপদ পিরুজালী গ্রামটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে হুমায়ূন আহমেদের ব্যতিক্রমী নিসর্গপ্রীতির কারণে। এলাকাবাসীর অনেকেই মনে করে, এখানে নুহাশপল্লী গড়ে না উঠলে এ পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ- কিছুই আসত না। এখানে একসময় কোনো রাস্তাঘাটই ছিল না। সরুপথে চলত গরুর গাড়ি। নুহাশপল্লী গড়ে ওঠার পর সেখানে গিয়ে পেঁৗছেছে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ। নগরীর সব সুবিধাই রয়েছে নুহাশপল্লীতে।
নিসর্গপ্রেমী হুমায়ূন আহমেদ শতাধিক ঔষধি গাছ দিয়ে এখানে গড়ে তুলেছেন এক প্রকৃতি জগৎ। এমন কোনো ফলদ গাছ নেই, যা ফলাননি তিনি এখানে। এই ঔষধি বাগানে চায়ের গাছ পর্যন্ত লাগিয়ে অতিথিদের সেই গাছের পাতা থেকে চা বানিয়েও খাইয়েছেন জীবনরসিক হুমায়ূন আহমেদ। এখানে রকমারি গাছ, লতাগুল্ম আর ফুল-ফলের গাছপালায় এমন এক আরণ্যক পরিবেশ রচনা করেছেন তিনি, যা বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক' উপন্যাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে অনেককে।
নুহাশপল্লীর ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বুলবুল ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'এখানে আমার চাকরির ১১ বছরে স্যারের মতো ভালোবাসা, স্নেহ আর আদরে সিক্ত হয়েছি। মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, সেটা শিক্ষা দেওয়ার একজন দক্ষ কারিগর ছিলেন হুমায়ূন স্যার।' তিনি বলেন, 'শেষবার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে গত বছরের ২ জুন বিমানবন্দরে স্যার আমাকে বলেছিলেন, আমার প্রিয় ভুবন নুহাশপল্লী দেখে রেখো, আমার গাছগুলোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। স্যারকে কথা দিয়েছিলাম। আমি কথা রেখেছি।'
বৃষ্টি আর জ্যোৎস্না- খুব প্রিয় ছিল হুমায়ূন আহমেদের। বৃষ্টির নাচ দেখার জন্য, সুর শোনার জন্য, জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় পরশ বুলানোর জন্য নুহাশপল্লীতে ছুটে যেতেন তিনি। প্রতি বর্ষায় এখানে তাঁর প্রিয় বৃষ্টি ঝরবে। লিচুতলা ভিজবে। কচিপাতা ভিজবে। লতাপাতা ভিজবে। পাখপাখালি ভিজবে। জ্যোৎস্না রাতে ঝরবে অপূর্ব আলো। চাঁদের মায়াবী আলো তাঁর সমাধির ওপর তৈরি করবে অপূর্ব নকশা। আলো-অন্ধকারে হয়তো কেউ তা দেখে গভীর বেদনায় বলে উঠবে- আহা রে! আহা রে!!

No comments

Powered by Blogger.