বড় মামা তুমি কোথায় গেলে by অপলা হায়দার

ছোটবেলায় একটা রচনা পড়তাম ‘সময়ের মূল্য’ নামে। প্রচণ্ড বোরিং এই রচনার একটি লাইন ছিল ‘সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায়।’ এই লাইনটি পড়লেই আমার রাগ উঠে যেত।
মনে হতো, কী আগা-মাথা ছাড়া একটা লাইন! এখন বড় হয়ে পরিষ্কার বুঝি এই লাইনের কী অর্থ। মনে হয় সেদিনের ঘটনা, বড় মামা দেশে এলেন, আমরা সবাই দেখতে গেলাম। সেদিন বারান্দায় অন্ধকারে বসে বড় মামা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। ভালো করে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। শিখু খালা বলল, ‘দাদাভাই, একটু আলোতে আসো, অমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না।’ বড় মামা যথারীতি রেগে গিয়ে বললেন, ‘ক্যান, অমি আমাকে আগে দেখে নাই? দেখার কী আছে?’ সবার সামনে ঝাড়ি খেয়ে মানে মানে চলে এলাম। মা বলল, ‘এমনি দাদাভাইয়ের রাগ বেশি, তার ওপর এত কেমো নিয়েছে, তাই মেজাজ গরম, মন খারাপ কোরো না।’ এদিকে এত মানুষের সামনে ঝাড়ি খেয়ে মন খারাপের চেয়ে বেশি যে আমার অপমানে লেগেছে, তা কাকে বলব? এর কয়েক দিন পরে বড় মামার তৈরি ঘেটুপুত্র কমলার প্রিমিয়ার শো হলো। সবাই গেল, আমি রাগ দেখিয়ে গেলাম না। সেদিন নাকি বড় মামা অনেক মজা করেছেন। এরপর আমার আর বড় মামার সঙ্গে দেখা হলো না!
শুধু মনে হয়, সেদিন আমার রাগ দেখিয়ে না গিয়ে কী লাভ হলো? কিছু কিছু কষ্ট হয়তো কখনো কমে না, আমার এই কষ্টটা তেমন। ১৯ জুলাই রাতে নীষা যখন ফোন দিয়ে বলল, ‘অমি আপু, ইয়াসমিন মামি বড় মামার জন্য দোয়া করতে বলছে।’ আমার তখন থেকে কান্না পাচ্ছে, কিন্তু এমন শরীর খারাপ ফোন আগেও এসেছে, পরে দেখা যায় আবার সবকিছু ঠিক থাকে। রাতে যখন রীতা মামির থেকে শুনলাম বড় মামা আর নেই, তখন আমরা ছুটলাম নানুর বাসায়। পথ যেন আর শেষ হয় না! নানুর রুমে গিয়ে দেখি, আমার নানুটা ছোট্ট হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘কই গেল তোমার বড় মামা?’ আহা রে কী যে কষ্ট! ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। আজ আর সেই সব কষ্টের কথা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বরং ছোটবেলার বড় মামার সঙ্গে কিছু স্মৃতি বলি:
স্মৃতি এক: ছোটবেলায় আমি কোথাও ঘুরতে গেলেই গাড়িতে উঠে বমি করতাম। বড় মামা বলল, ডাকনামটাই কাল হয়েছে ‘অমি করে বমি’। আমি সারা ছোটবেলা জানতাম সত্যি বুঝি, নামের কারণে আমি গাড়িতে উঠলেই বমি করি!
স্মৃতি দুই: আমরা তখন ঈদ করতে পিরোজপুর গেলাম। ঈদের আগে আগে আমাদের তিন বোনের জন্য মানি অর্ডার এল। চিরকুটে আমাকে লেখা, ‘অমি, ঈদের সালামির টাকা পাঠালাম। তোমার বয়স ৭, কাজেই ১৪ টাকা। বড় মামা’ আমি সাইন করে টাকা নিলাম। আমাদের তিন বোনের বয়স মিলিয়ে ৪০ টাকারও কম টাকা পোস্টমাস্টার মায়ের হাতে দিলেন। বড় মামার নিয়ম ছিল, যার যত বয়স, তার ডাবল টাকা সালামি পাবে। এত কম টাকা ঢাকা থেকে মানি অর্ডার করেছে দেখে পোস্টমাস্টার একবার বাসার দিকে তাকান, একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে চলে গেলেন।
স্মৃৃতি তিন: তখন আমি ক্লাস ফাইভে বা সিক্সে পড়ি। বড় মামা সবাইকে নিয়ে ভারত ঘুরতে যাবেন। যেহেতু জীবনের প্রথম বিদেশ যাচ্ছি, আমি পাসপোর্টে ইংরেজিতে সাইন দিলাম। সাইনটা আবার একটু জটিল। ও এর ভেতর পি ঢুকিয়ে অপলা লেখা। বড় মামা সাইন দেখে বললেন, ‘এতটুকু মেয়ে এই সাইন দিলে তো জাল পাসপোর্ট ভেবে ধরবে তোমাকে আর যেতে দেবে না।’ বড় মামার কথা কিঞ্চিৎ সত্যি হয়ে গেল। আমাকে এয়ারপোর্টে আটকাল! একটা কাগজ দিয়ে বলল আবার সাইন করতে। করার পর তা মিলিয়ে দেখে আমাকে ঢুকতে দিল!
স্মৃতি চার: রোজার ঈদে বড় মামার বাসায় গিয়েছি। ঈদে সালাম করব, কিন্তু বড় মামা খাবার রুমে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। বড় মামাকে যেহেতুখুব ভয় পাই, ফলে ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘বড় মামা, সালাম করব।’
বড় মামা বললেন, ‘পা নামাতে পারব না। হাঁটু সালাম করে চলে যাও।’ আমি তাড়াতাড়ি হাঁটু সালাম করে ফেললাম। বড় মামা সালামি গুনে গুনে ১৪ টাকা দিলেন! বড় মামার নিয়ম অনুযায়ী যার যত বয়স, সে ডাবল টাকা পায়। টাকার ব্যাপার তাই ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললাম, ‘বড় মামা, আমার বয়স ১৪ হয়ে গিয়েছে, আমি ২৮ টাকা পাব।’
—‘হুম পেতা, কিন্তু হাঁটু সালাম করায় ২৮ টাকা থেকে ১৪ টাকা মাইনাস হয়ে গিয়েছে!’
স্মৃতি পাঁচ: আমাদের বিয়ের কার্ড দেওয়ার সময় বড় মামা একটা চেক দিয়ে বললেন, ‘এমন কিছু কেনো, যাতে সব সময় বড় মামার কথা মনে পড়ে।’ আমি অনেক ভেবেচিন্তে প্রায় পুরো বাসায় আইপিএস লাগিয়ে ফেললাম। আমার সহজ-সরল হিসাব ছিল, কারেন্ট যাবে-আসবে, বড় মামার কথা মনে পড়বে!
জীবনের চাকা আবার চলতে থাকবে, এটাই নিয়ম। কোনো কিছুই থেমে থাকে না। কিন্তু একজন সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোরও যে মৃত্যু হয়, তা বড় মামা চলে যাওয়ার পর বুঝলাম।
অপলা হায়দার: হুমায়ূন আহমেদের ভাগনি, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।

No comments

Powered by Blogger.