আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে এক হাজার ২২৫ ব্যক্তিকে গণহত্যা, চারজনকে হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণসহ ছয়টি অভিযোগে আন্তর্জাতিক
অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না সে বিষয়ে আগামী ২৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল-১-এ শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
এদিকে খোকন রাজাকার হিসেবে পরিচিত ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এ ছাড়া জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-১-এ অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়েছে। একই ট্রাইব্যুনালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্যগ্রহণ পিছিয়েছে ২১ জুলাই পর্যন্ত। এ ট্রাইব্যুনালে লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্টের বিরুদ্ধে জারি করা আদালত অবমাননার বিষয়ে আগামী ২৭ আগস্ট আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ প্রবাসী দুই বাংলাদেশি চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া শেষ করেছেন একাত্তরে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর চৌধুরী তন্ময়। আগামী ২১ জুলাই পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে আসামিপক্ষের শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু আসামিপক্ষের আবেদনে আগামী ২২ জুলাই দিন ধার্য করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও হবিগঞ্জের জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে ২১ আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন অথবা অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২।
আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে গতকাল ছয় অভিযোগে ৩০০ পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর নূরজাহান বেগম মুক্তা ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে এটা দাখিল করেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়েছে। আজহারের বিরুদ্ধে মামলায় ২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। গত বছরের ২২ আগস্ট তাঁকে ঢাকার মগবাজারের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
আজহারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী ন্যাপ নেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণের পর নির্যাতন করা হয়। এরপর তাঁদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে গণহত্যার সঙ্গে এ আসামি জড়িত ছিলেন। অভিযোগে আরো বলা হয়, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে গণহত্যার সঙ্গে এ আসামি জড়িত ছিলেন। এ আসামি একই বছরের ১৭ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিল এলাকায় ১২০০-র বেশি নিরীহ লোককে ধরে নিয়ে গণহত্যা চালানোর সঙ্গে জড়িত। ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার সঙ্গেও এ আসামি জড়িত। এ ছাড়া একজন মহিলাকে ধর্ষণেরও অভিযোগ আনা হয়েছে জামায়াতের এ নেতার বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে রংপুর অঞ্চলে শত শত বাড়িঘরে অগি্নসংযোগের অভিযোগও আনা হয়েছে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র থাকাকালে এ আসামি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এবং ওই জেলার আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে তিনি অপরাধ সংঘটন করেন বলে অভিযোগে বলা হয়।
খোকন রাজাকারকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিচারের জন্য আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে আসামিপক্ষকে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করতে প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আগামী ৩০ জুলাই অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। গত ২৩ জুন রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগে ফরমাল চার্জ দাখিল করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করে।
বিএনপির এ নেতার বিরুদ্ধে ১৬ নারী ও শিশুসহ ৫০ জনকে হত্যা, তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা, দুজনকে ধর্ষণ, ৯ জনকে ধর্মান্তরিত করা, দুটি মন্দিরসহ ১০টি গ্রামের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগি্নসংযোগ, গ্রামবাসীকে সপরিবারে দেশান্তরে বাধ্য করা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কাসেম আলীর বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুলাই
ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য গতকাল দিন ধার্য ছিল। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবু বকর সিদ্দিকী অভিযোগ গঠনের শুনানি ছয় সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে আবেদন করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আজ (বৃহস্পতিবার) কিছু ডকুমেন্ট দিয়েছে। এসব ডকুমেন্ট পড়ে প্রস্তুতির জন্য ছয় সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এরপর ট্রাইব্যুনাল আগামী ২৫ জুলাই পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করেন। গত ২৬ মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গত ১৬ মে রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। গত বছরের ১৭ জুন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেম আলীকে মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে। সেই থেকে তিনি কারাগারে।
'বুদ্ধিজীবীদের হত্যার সঙ্গে মঈনুদ্দীন-আশরাফুজ্জামান জড়িত ছিল'
'একাত্তরে বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে প্রবাসী দুই বাংলাদেশি চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান জড়িত ছিল' বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর চৌধুরী তন্ময়। রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে তিনি এ সাক্ষ্য দেন। তিনি গতকাল ট্রাইব্যুনাল-২-এ বলেন, আলবদর বাহিনীর অপারেশন-ইন-চার্জ মঈনুদ্দীন ও চিফ এঙ্িিকউটর আশরাফুজ্জামান তাঁর বাবাসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ, গুম এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর বাবা শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, '১৯৭২ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে আমার কাকা শমসের চৌধুরী রুশো চিনতে পারেন যে তিন-চার তরুণের মধ্যে এই দুজন আমার বাবাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল।' তিনি বলেন, '১৬ ডিসেম্বরের পর শুনতে পাই, মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে। তখন রুশো কাকা ও বড় চাচা রায়েরবাজারে বাবাকে খুঁজতে যান। সেখানে পড়ে থাকা বিকৃত, আধাবিকৃত বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলোর মধ্যে বাবার লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।' তিনি বলেন, ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, শহীদ অধ্যাপক আবুল খায়ের, শহীদ অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, শহীদ ডাক্তার মর্তুজা, শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, শহীদ অধ্যাপক রাশেদুল হাসানসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রস্তুত করে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ তালিকার একটি কপি 'জল্লাদের ডায়েরি' শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই ডায়েরির পাতায় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীসহ বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। তিনি বলেন, রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ঘাতকের গুলির আঘাত থেকে প্রাণে বেঁচে আসা দেলোয়ার নামের একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই লোক তাঁকে জানান যে ১৪ ডিসেম্বর তাঁকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে অনেক বন্দির সঙ্গে রাখা হয়েছিল। সেখানে তিনি বারবার মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হতে শোনেন এবং তাঁদের নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য দেখেন। তিনি বলেন, পরে বিভিন্ন সময় জানতে পারি, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন এবং তাঁর নামও উচ্চারণ করেছিলেন। জবানবন্দি পেশ শেষে আসিফ মুনীরকে জেরা করেন আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনি।

No comments

Powered by Blogger.