বাস্তবায়নই সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ সংশোধিত শ্রম আইন

তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিলের পটভূমিতে অবশেষে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০১৩ পাস হলো। শ্রমিক, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক ক্রেতামহলের প্রধান দাবি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এই আইনে স্বীকার করা হয়েছে, যদিও সে ক্ষেত্রে বিধিনিষেধও কম নয়।
নতুন আইনে দেশি-বিদেশি চাপে প্রণীত এই আইনে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, বিমাসুবিধা, ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রসূতিকালীন ছুটি, কারখানার নিরাপত্তা, ভবনের নকশা ইত্যাদি জরুরি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বাধা অপসারণই এ আইনের ইতিবাচক দিক। নতুন আইনে জাহাজনির্মাণ, জাহাজভাঙা, ওয়েল্ডিং, মোবাইল অপারেটর কোম্পানি, কৃষিশ্রমের সঙ্গে জড়িতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের বেলায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার না দেওয়া সমীচীন হয়নি বলেই মনে করি। সেখানে কর্মরত শ্রমিকেরা অধিক সুবিধা পেলেও তাঁদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া সমীচীন বলেই আমরা মনে করি।
পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো দূর করা প্রয়োজন। বিষয়টি অনুধাবন করেই সম্ভবত সরকার বিধিমালা জারি করতে যাচ্ছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী সংশোধিত শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে। কারখানার মোট শ্রমিকের ৩০ শতাংশ সদস্য নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাহীন মালিক-শ্রমিক সহযোগিতা কমিটি, শ্রমিকদের বাইরে থেকে কারও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে না পারার বিধানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি দাবিদাওয়া আদায়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারকেও মালিক ও সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ রেখে কার্যত অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। বিদেশি মালিকানাধীন কারখানায় প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছর ধর্মঘট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং একদিকে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত, অন্যদিকে আন্দোলনের পথ সংকীর্ণ করে দেওয়ায় শ্রমিকদের সংগঠিত হয়ে দাবিদাওয়া আদায়ের পথ কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে সীমিতই থাকবে।
২০০৯ সালে উচ্চ আদালত কর্মস্থলে যৌন নিপীড়ন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও এই আইনে নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতিকারের বিধান নেই। শ্রমিকদের নিয়োগ ও বরখাস্ত, প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মালিকের অনিয়ম রোধের শর্ত আইনে স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে আইনটি আগের তুলনায় ভালো মনে হলেও শর্তের কারণে শ্রমিকদের দুর্দশা দূর করার শক্তিশালী হাতিয়ার হবে কি না সন্দেহ।
কেবল জিএসপি সুবিধা পাওয়া বা রক্ষার জন্য নয়, দেশে টেকসই শিল্পায়নের জন্যই শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি থাকা জরুরি। মালিকদের মনে রাখতে হবে, উৎপাদনে যে পুঁজি ও যন্ত্র নিয়োজিত থাকে, তার চেয়ে সেই যন্ত্রের চালক শ্রমিকদের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। নতুন শ্রম আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, এতে শ্রমিকদের যেটুকু অধিকার দেওয়া হয়েছে, মালিকেরা যাতে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন, সেই ব্যাপারেও সরকারের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.