বিশ্বব্যাংকের সাফ কথা-তদন্ত স্বচ্ছ হলেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সতর্কবার্তা দিল বিশ্বব্যাংক। গতকাল শনিবার সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুদক পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ স্বচ্ছ, পূর্ণাঙ্গ এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলেই এ প্রকল্পে সহায়তার পথে এগোবে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, 'দুদক যদি দুর্নীতির সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণের ভিত্তিতে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করে, তাহলেই কেবল পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসবে।' আর তদন্তে সহযোগিতা করতে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণ দুদককে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি।
তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের ঢাকা ছাড়ার তিন দিন পর বিশ্বব্যাংক এ বিবৃতি দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে সংস্থাটির সঙ্গে সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছানো এখনো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীও আশা প্রকাশ করে বলেছেন, 'আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব। আর আলোচনা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা ডুবব।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুদক বা সরকারকে চাপে রাখতেই শনিবার এ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, যাতে তদন্তে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব না হয়। এখন অনুসন্ধানদলের খসড়া প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছেন দুদকের চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার ও একজন আইন উপদেষ্টা। চলতি সপ্তাহে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের কাছে পাঠানোর কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করবে প্যানেলের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও মতামত। তাই প্রতিবেদন চূড়ান্তের আগেই দুদককে সতর্কবার্তা দিয়ে রাখল বিশ্বব্যাংক।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছ থেকে সন্তোষজনক মতামত পেলেই বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে- এমন কথাই সরকার ও সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর সরকার যখন একটি ইতিবাচক সাড়ার অপেক্ষায় রয়েছে, এ সময় সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো এ বিবৃতি কিছুটা সংশয়েরও সৃষ্টি করেছে। দুদকের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের মনঃপূত না হলে সংস্থাটি আবারও নেতিবাচক অবস্থানে ফিরে যেতে পারে- এ সম্ভাবনার আগাম অজুহাত হিসেবেও অনেকে দেখছেন এ বিবৃতিকে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গত ১৪ অক্টোবর তাদের প্রথম সফরে বাংলাদেশের আইন অনুসরণ করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য দুদককে উৎসাহিত করেছিল। বিশ্বব্যাংক ও দুদকের প্রাপ্ত সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের তাগিদ দিয়েছিল বিশেষজ্ঞ প্যানেল। গত ১ ডিসেম্বর এ প্যানেল দ্বিতীয় দফায় ঢাকা সফরে আসে। দ্বিতীয় সফরে দুদকের সামনে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় তুলে ধরে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য দুদককে পুনরায় উৎসাহিত করেছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। দুর্নীতি দমন কমিশন যখন তাদের পর্যালোচনা শেষ করবে এবং তদন্তের বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে, তার পরই বিশেষজ্ঞ প্যানেল একটি বিবৃতি দেবে।
গত ১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় ঢাকা সফরে আসেন লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। চার দিনের এ সফরে দুদকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক শেষে ৫ ডিসেম্বর ঢাকা ছেড়ে যান বিশেষজ্ঞরা। মামলায় কাদের কোন ধারায় অভিযুক্ত করা হবে- এ নিয়ে দুদক ও প্যানেলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় দুদকের পক্ষ থেকে সময় নেওয়া হয়েছে।
দুদক ও সরকারি সূত্রগুলো জানায়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা এক বছর ধরে বলা হলেও ১৩ নভেম্বরের আগে কোনো প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুদককে দেওয়া হয়নি। পরে এসব দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে নতুনভাবে অনুসন্ধান করে দুদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি দল। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, ছুটিতে যাওয়া সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াসহ আরো কয়েকজনের সাক্ষাৎকার আবারও নেওয়া হয়। ২০ দিনের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ৪ ডিসেম্বর অনুসন্ধানদল তাদের খসড়া প্রতিবেদন জমা দেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে, ওই প্রতিবেদনে তা নিশ্চিত করা হয়। পরদিনই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বসে অভিযুক্তদের শনাক্ত করে মামলার তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি দুদক। ওই দিনই বিশেষজ্ঞ প্যানেল চলে যায়।
সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কারো নাম অন্তর্ভুক্তি বা বাদ দেওয়ার ব্যাপারে দুদকের ওপর কোনো চাপ নেই। সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'অভিযুক্তদের নামের তালিকা নিয়ে দুদকের কমিশনাররাই একমত হতে পারছেন না। এ জন্যই তাঁরা সময় নিয়েছেন। আশা করি, শিগগিরই তাঁরা তা করতে পারবেন।'
তিনি জানান, দুদকের অনুসন্ধানদলের খসড়া প্রতিবেদনে ১০ জনের নাম থাকলেও মামলার তালিকায় তাঁদের সবাইকে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সংস্থাটির তিনজন কমিশনার একমত হতে পারেননি। তিন কমিশনার একমত না হলে দুদক সাধারণত এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় না।
দুদকের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক এখতিয়ারের বিষয়ে আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে দুদকের তিনজন কমিশনারের মধ্যে দুজন যেদিকে মত দেবেন, সেটিই বাস্তবায়িত হবে।
বিস্মিত অর্থমন্ত্রী, আশাবাদী রিজভী
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় সিলেট থেকে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, 'হঠাৎ করে এই বিবৃতিতে আমি সারপ্রাইজড (বিস্মিত) হয়েছি। আমাদের দুদক সুষ্ঠুভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ করছে দুদক। এই অবস্থায় আকস্মিক এই বিবৃতিকে আমি ওয়েলকাম (স্বাগত) করতে পারছি না।'
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থানের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ বিলম্বিত হবে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমি এখনো আশাবাদী, এই বিষয়টির একটি সম্মানজনক সমাধান হবে। আমি বারবার বলে আসছি, চলতি অর্থবছরের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারব।'
অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার এখনো দুর্নীতির তদন্ত ও সেতু বাস্তবায়ন একসঙ্গে করার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। দ্রুতই তা সম্ভব হবে বলেও আশা করেন তিনি।
ঢাকার এলজিইডি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ড. গওহর রিজভী বলেন, 'জটিল কিছু বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এটা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা ডুবব। তবে আশা করছি, আবার একসঙ্গে কাজ করতে পারব আমরা।'

No comments

Powered by Blogger.