শ্রদ্ধাঞ্জলি-কোনো মৃত্যু এখন মেনে নিতে পারছি না by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

কোনো মৃত্যু এখন মেনে নিতে পারছি না। তার কারণ কি আমি নিজেই মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হচ্ছি! মৃত্যু আমাদের পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দেবে, যে পৃথিবী এতদিন আমাদের পুষ্টি দিয়েছে। আমরা মাটিতে ফিরে যাব। মাটি, শেষ পর্যন্ত, আমাদের গন্তব্য।
এই গন্তব্যে আমাদের পেঁৗছতে হবে। জীবনে বেঁঁচে থাকার ঔদ্ধত্য নিয়ে যা কিছু আমরা বলি কিংবা করি, কোনো কিছুই মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। মৃত্যু আসে, এসে টোকা দেয় দরজায়।
মুরশিদ স্যার বিজয়ের মাসে চলে গেলেন। পাকিস্তানের কলোনি কালকে বাঙালিমাত্র অস্বীকার করেছেন, কলোনি কালের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, কলোনি কালকে জ্ঞান দিয়ে পরাজিত করেছেন_ তাদের মধ্যে মুরশিদ স্যার অন্যতম। আমরা যারা তার ছাত্র, আমরা শিখেছি তার কাছ থেকে জ্ঞান কেন দরকার। জ্ঞান বাদে স্বাধীনতার লড়াই করা যায় না। এই জ্ঞানের পতাকা তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তুলে ধরেছেন। তিনি নিউ ভ্যালুজ পত্রিকা বার করে কলোনির পূর্ব বাংলায় আধুনিকতার প্রবল বাতাস বইয়ে দিয়েছেন। সাহিত্য দরকার ইতিহাসের জন্য, ইতিহাস দরকার রাজনীতির জন্য, দর্শন দরকার বিরাট জীবনকে নতুনভাবে বোঝার জন্য। একঝাঁক শিক্ষক একসঙ্গে এই কাজটা করেছেন :খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুর রাজ্জাক, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, মুজাফফর আহমেদ :রেনেসাঁস এভাবেই তারা এনেছেন, আর আমাদের উপহার দিয়েছেন, আমরা যারা তাদের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমনরুমে কিংবা শিক্ষকদের ক্লাবে কিংবা তাদের বাড়িতে যাওয়া আমাদের জন্য এক পরম শিক্ষা, এক পরম সৌভাগ্য ছিল। আমরা তাদের কথা শুনে শিখতাম জ্ঞান কত বিশাল, জ্ঞানের আলোচনা কেন এত সুখ তৈরি করে।
মুরশিদ স্যার এবং আমার অন্য শিক্ষকরা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমাদের জন্য, ছাত্রদের জন্য তৈরি করেছেন বেঁচে থাকার জন্য লিবার্টি কেন দরকার। কলোনিতে লিবার্টি নেই, আর এই লিবার্টির জন্য আমাদের লড়াই দরকার। জ্ঞানের মুক্তির জন্য লিবার্টি দরকার আর এই লিবার্টির জন্য দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোনমি, আর আমার এই শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোনমিকে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। আমি কী করে ভুলব রাজ্জাক স্যারের হো-হো হাসি, কী করে ভুলব মুরশিদ স্যারের নম্র অথচ ধারালো কথাবার্তা, কী করে ভুলব জ্যোতির্ময় স্যারের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে কৌতূহল, কী করে ভুলব মুজাফফর স্যারের সাংবিধানিক জ্ঞানের পরিসর, কী করে ভুলব হবিবুল্লাহ স্যারের ইতিহাসবোধ। ভোলা যায় না। তারা আমাদের পড়াননি, তারা আমাদের শিখিয়েছেন। আমরা আজীবন তাদের ছাত্র।
আমি আমার শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের দয়ায় ব্যক্তিগত সম্পর্কে প্রবেশ করতে পেরেছি, যে সম্পর্ক বন্ধুত্বের পর্যায়ে বদলে গেছে, আর এই বন্ধুত্ব গভীরভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে এবং স্থায়ীভাবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। আমি তাদের ছাড়া এখন বাঁচব কী করে। আমার চোখে ভাসছে তাদের মুখ, তাদের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, তাদের কথা। মুরশিদ স্যার এবং তারা সবাই এভাবেই আমাকে ঘিরে আছেন। আমরা নিজেদের প্রস্তুত করছি ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেখানে আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে।

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বিশিষ্ট কবি ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.