দুর্নীতি দমনে লোকপাল by গৌতম লাহিড়ী

ভারতে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতি দমনে স্বশাসিত লোকপাল সাংবিধানিক সংস্থা গঠনে শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্টের সব ক'টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বসম্মতি তৈরি হলো। ফলে ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ রূপায়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি দমনে স্বাধীন সংস্থা গঠিত হলে ভবিষ্যতে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি পরিবর্তিত হওয়া নিয়ে। কেননা, ভারতে প্রধানমন্ত্রীর নেত্বত্বে গঠিত মন্ত্রিসভা একমাত্র লোকসভার প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু যে লোকপাল নিয়ে সর্বসম্মতি তৈরি হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিধায়ক এবং সর্বস্তরের সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করতে পারবে_ এমনকি চার্জশিট পেশ করারও অধিকার রয়েছে লোকপালের। তবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে একমাত্র ছাড় দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ এবং জনশৃঙ্খলা বিষয়ে। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে লোকপাল তদন্ত করতে পারবে না।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে লোকসভায় লোকপাল বিল পাস হয়েছিল। কিন্তু সেই বিলটি নিয়ে প্রবল আপত্তি ওঠায় রাজ্যসভায় বিলটি পাস করাতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতে কোনো আইন প্রবর্তন করতে হলে লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাস করাতে হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের মে মাসে রাজ্যসভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যেক দলের মত নিয়ে লোকপাল বিল তৈরি করা হবে। রাজ্যসভায় কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজবাদী পার্টিসহ ১৫ জন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত হয় সিলেক্ট কমিটি। সেই কমিটি ১৯ বার বৈঠকে বসে গত ১৯ নভেম্বর রাজ্যসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তসহ রিপোর্টটি পেশ করে। এবার কেন্দ্রীয় সরকার এই কমিটির সিদ্ধান্তমতো লোকপাল বিল নতুনভাবে পেশ করবে। সেটি রাজ্যসভার পর লোকসভায় ফের পাস করাতে হবে। তারপর লোকপাল গঠিত হবে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি অনুমোদন দেওয়ার পর।
এবারে যে বিলটি তৈরি হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ভারতের প্রত্যেক রাজ্যে লোকপালের মতো সংস্থা গঠন করতে হবে এক বছরের মধ্যে। তবে রাজ্যের বিল তৈরির স্বাধীনতা থাকবে রাজ্য সরকারের ওপর। প্রস্তাবিত লোকপাল সংস্থায় একজন চেয়ারম্যান হবেন এবং মোট সদস্য আটজন। এর ৫০ শতাংশ সদস্য হবেন আইন বিশেষজ্ঞ এবং অবশিষ্ট সদস্য হবেন নিম্ন জাতির_ তফসিলি জাতি-উপজাতি, অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণী, সংখ্যালঘু (মুসলিমসহ) এবং মহিলা সম্প্রদায়ের। তবে তারা কেউ-ই কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না। তাদের নির্বাচন করবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার স্পিকার, লোকসভার বিরোধী নেতা, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং বিশিষ্ট নাগরিক নিয়ে গঠিত কমিটি। লোকপাল যেমন প্রাথমিক অভিযোগের তদন্ত করবে, তেমনি স্বাধীন সংস্থা থাকবে শাস্তি প্রক্রিয়া শুরু করার।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে লোকপালের পুরো বেঞ্চের বৈঠকে এবং তাতে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করবে লোকপাল। যেসব সংস্থা বছরে বিদেশ থেকে ১০ লাখ রুপি অনুদান পেয়ে থাকে, তাদেরও লোকপালের আওতায় আনা হয়েছে। এমন ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্তের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে লোকপাল। যেসব দেশীয় সংস্থা বা এনজিও সরকারি অনুদান পেয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এলে লোকপাল তদন্ত করতে পারবে।
সংসদের এই সিলেক্ট কমিটি ভারতের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআইয়ের গঠন সংস্কার করার সুপারিশ করেছে। কেননা মূলত বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল, সিবিআইকে শাসক দল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। সংসদে জমা পড়া রিপোর্টের তিন নম্বর পাতায় লেখা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটি সিবিআইয়ের অধিকর্তা চয়ন করবে। যদি সিবিআইকে কোনো অভিযোগ তদন্ত করতে দেওয়া হয় লোকপাল সেই তদন্তের তত্ত্বাবধান করবে। সিবিআইকে নির্দেশ দিতেও পারবে, যা এতদিন ভারতে চালু ছিল না এবং দু'বছরের মধ্যে অধিকর্তাকে অপসারণ করা যাবে না।
লোকপালের কাছে অভিযোগ জমা পড়ার পর তিন মাসের মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করতে হবে। ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। প্রয়োজনে এই সময় আরও ছয় মাস বাড়ানো যাবে। অভিযোগের বিচার মোট দুই বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে। শাস্তির নূ্যনতম মেয়াদ দু'বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর। লোকপালের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অপসারণ করা যাবে। লোকপালে অসত্য অভিযোগ আনলে জরিমানা ও জেলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
গত কয়েক বছর কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এই দুর্নীতি রোধ করতে কেন্দ্রীয় সরকার লোকপাল বিল প্রবর্তন করতে চায় না_ এই অভিযোগ এনে সুশীল সমাজের নেতা আন্না হাজারে এবং টিম আন্না আন্দোলন শুরু করেন। এখন কেন্দ্রীয় সরকার এই বিল পেশ করে সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে চাইছে। কিন্তু টিম আন্না এতেও সন্তুষ্ট নন। এই বিল যথেষ্ট নয় বলে অরবিন্দ কেজরিওয়াল মন্তব্য করেছেন। তবে একটাই স্বস্তি কেন্দ্রের, সব ক'টি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে একটি বিলের খসড়া তৈরি করেছে। কংগ্রেস দল লোকসভা ভোটে এটাই প্রচার করার রণনীতি নিয়েছে।

গৌতম লাহিড়ী :সমকাল প্রতিনিধি নয়াদিলি্ল

No comments

Powered by Blogger.