না-ফেরার দেশে খান সারওয়ার মুরশিদ

দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত না-ফেরার দেশে চলে গেলেন শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদ। গতকাল শনিবার রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে পারিবারিক সূত্র জানায়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
খবর পেয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রমুখ।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদ, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বাণী দিয়েছেন।
চলতি বছর অক্টোবর মাসে পরপর দুইবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্যের। এ অবস্থায় গত ১৮ অক্টোবর তাঁকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
খান সারওয়ার মুরশিদের বড় মেয়ে তাজীন মেহনাজ মুরশিদ বলেন, 'সপ্তাহখানেক আগে গুরুতর হার্ট অ্যাটাকের পর বাবার অবস্থার অবনতি ঘটে। এরপর তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। এর আগে তাঁর অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়ায় লাইফ সাপোর্ট খুলে রাখা হয়েছিল। আজ (শনিবার) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আপনারা তাঁর বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করবেন।'
পারিবারিক বন্ধু আমিনুর রাহমান রানা বলেন, 'খান সারওয়ার মুরশিদের মরদেহ আজ (শনিবার) রাতে হাসপাতালেই থাকবে। আগামীকাল (রবিবার) সকালে লাশ প্রথমে তাঁর বাসা গুলশানে নিয়ে যাওয়া হবে। বাদ জোহর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে গুলশানের আজাদ মসজিদে। আজাদ মসজিদ থেকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে। এরপর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।' তিনি আরো জানান, শহীদ মিনারে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ আসর শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর লাশ মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে।
শোক প্রকাশ : রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এক শোকবার্তায় শিক্ষা বিস্তারে সারওয়ার মুরশিদের অবদান স্মরণ করেন। তিনি বলেন, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ দেশে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক শোকবার্তায় খান সারওয়ার মুরশিদের অবদান স্মরণ করে বলেন, 'তাঁর মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো।' প্রধানমন্ত্রী তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং পরিবারের শোকসন্তপ্ত সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
শোক প্রকাশ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'আমরা একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে হারালাম। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ও অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ একজন শিক্ষক। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের জন্য যা যা করা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে তা করা হবে।'
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, "নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন নির্ভীক সাহসী পুরুষ। যখন রবীন্দ্র শতবার্ষিকী পালনে প্রাণের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি তখন তিনি এগিয়ে এসে নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তান আমলে 'নিউ ভেল্যুজ' নামে একটি অসাধারণ পত্রিকা প্রকাশ করতেন, যার জন্য তাঁকে পাকিস্তান সরকারের কোপানলে পড়তে হয়। তাঁর মৃত্যুতে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়।"
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, 'খান সারওয়ার মুরশিদের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। তিনি ছিলেন দলাদলির ঊধর্ে্ব নিরপেক্ষ, স্বাধীনচেতা, মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন সাহসী পুরুষ। এরশাদ আমলসহ সাধারণ মানুষের পক্ষে তিনি বহু আন্দোলন করেন।'
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন : ৮৮ বছর বয়সী শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদের জীবন বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এই গুণী শিক্ষকের । ১৯২৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লায় নানাবাড়ি 'মুনসেফ বাড়ি'তে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের নাসিরাবাদে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে। ১৯৪৫ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ১৯৪৭ সালে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি।
১৯৫৫ সালে ইংল্যান্ডের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন তিনি। পরে আবারও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য যান আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা নীতি নির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বঙ্গবন্ধু ও মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শকদের একজন ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পালন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব।
১৯৭৫ সালে একই সঙ্গে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খান সারওয়ার মুর্শিদ। ১৯৭৭-৮২ সাল পর্যন্ত কমনওয়েলথের সহকারী মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে ১৯৮৩ সালে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে অবসর গ্রহণ করলেও ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। খান সারওয়ার মুরশিদ ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
শিক্ষা ও গবেষণায় অসাধারণ অবদানের জন্য মহান এ শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে। প্রবন্ধ ও গবেষণায় অবদান রাখায় ২০১১ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক, কণ্ঠশীলন পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন খান সারওয়ার মুরশিদ। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। খান সারওয়ার মুরশিদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় মেয়ে শারমিন মুরশিদ, ছোট মেয়ে তাজীন মেহনাজ মুরশিদ, বড় ছেলে খান আনোয়ার সায়ীদ মুরশিদ ও ছোট ছেলে কুমার মুরশিদ (খান আহমেদ নোয়াইদ মুরশিদ)।

No comments

Powered by Blogger.