অপরাধতুল্য অবহেলার দৃশ্যপট by এ এম এম শওকত আলী

ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে অপরাধতুল্য অবহেলার (criminal negligence) জন্য কারো যদি ক্ষতি হয় তাহলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য। অপরাধতুল্য অবহেলার ঘটনার নজির এ দেশে অসংখ্য। দণ্ডবিধি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিশেষ আইনেও দণ্ডের বিধান রয়েছে। যেমন যানবাহন চালানো সংক্রান্ত অপরাধ।
বেপরোয়া যান চালানোর জন্য বহু ব্যক্তির মৃত্যু প্রতিদিনই এ দেশে ঘটছে। এদের মধ্যে অনেকে প্রাণে বাঁচলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করতে বাধ্য হন। এসব ঘটনার জন্য অতি নগণ্যসংখ্যক দায়ী গাড়িচালক দণ্ডিত হয়। এর ফলে এ ধরনের অন্য গাড়িচালকরা দণ্ডের ভয়ে ভীত নন। পরিবহন খাতে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনপথ ছাড়াও নদীপথেও একই দৃশ্য যদিও তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম।
এর অন্য উদাহরণ খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বিক্রির ওপর ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এর জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমের দৃশ্যও দেখা যায়। ছোট-বড় সব বিক্রয়কেন্দ্রেই এ আদালত অভিযান চালান। দণ্ডও দেন। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান এখনো হয়নি। ফরমালিন মেশানো মাছ বিক্রি কয়েক বছর ধরেই চলছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য যে এটা হুমকি সে বিষয়টিও আলোচিত হয়। মাছে ফরমালিন রয়েছে কি না তা সহজে নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপদেশও পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও শীর্ষ ব্যবসায়ী সংস্থা ফরমালিনমুক্ত বাজার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এর ফলে ঢাকার চার বা পাঁচটি বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ কতটা সফল তার মূল্যায়ন জরুরি। কারণ এ ধরনের উদ্যোগ যদি নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা হয় তাহলে কোনো স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে না। তবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন রয়েছে। ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতাদের জন্য এ সচেতনতা অধিকতর জরুরি। নিবিড় পরিবীক্ষণের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অথবা শীর্ষ ব্যবসায়ী সংস্থার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাব-পুলিশের পক্ষেও এ কাজ সম্ভব নয়। সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব। তবে এখানেও কিছু অপূর্ণতা রয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মূলত ক্রেতাদের জন্য সহনীয় মূল্য নিশ্চিত করার মধ্যেই বর্তমানে সীমিত। কারণ এ বিষয়টি নিয়ে সবাই সরব।
বাজারসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় নিয়ে কেউ তত আগ্রহ প্রকাশ করে না। যেমন বাজারের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। কোনো পণ্যের দাম জিজ্ঞেস করলেই প্রথমেই বিক্রেতা দামটা যত বেশি সম্ভব তা বলে। দরকষাকষি ছাড়া কাঁচা বাজারে কোনো পণ্য কেনা সম্ভব নয়। তবে ধনীদের জন্য কিছু সুপারমার্কেটে এ দৃশ্য দেখা যায় না। পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তাঁরা সচেতন। তবে দরকষাকষির কোনো সুযোগ নেই। কোনো কোনো কাঁচা বাজারের দৃশ্য আরো ভয়ানক। বিক্রয়কেন্দ্রের সামনেই খাসি জবাইয়ের বিষয়টি দৃশ্যমান।
সাম্প্রতিককালে অপরাধতুল্য অবহেলার নতুন দৃশ্যপট মূলত দুটি ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। এক. শিল্প-কারখানায় আগুনের ঘটনা; দুই. ফ্লাইওভার বা সমতুল্য অবকাঠামো ধসে পড়া। বিগত অক্টোবর মাসে এ ধরনের ঘটনার বিষয় কারো অজানা নয়। তবে আবাসিক বা বাণিজ্যিক এলাকায়ও অগ্নিসংক্রান্ত দুর্ঘটনা অতীতে ঘটেছে। যেমন ঢাকার কায়েতটুলী বা নিকটস্থ মহল্লায় রাসায়নিক দ্রব্যজাত কারখানা, যা আবাসিক এলাকায় ছিল, এটাও ছিল অতি মর্মান্তিক আগুনের ঘটনা। সোনারগাঁও হোটেলের বিপরীতে অবস্থিত বাণিজ্যিক অফিসের আগুনের দুর্ঘটনার বিষয়টিও ছিল ভয়াবহ। ওই সময় থেকে অগ্নি প্রতিরোধসংক্রান্ত আইনের বিধিবিধান কেউ মানে না, এ কথাও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট বহুতল অবকাঠামোর জন্য যেসব সুবিধা থাকার কথা, তা থাকে না। বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনাও বিরল নয়। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য মিডিয়া প্রকাশ করেছে। ১২ থেকে ১৪ জন ব্যক্তি এর ফলে মৃত্যুবরণ করেছে। বিভিন্ন মহল থেকে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি উঠেছে। চিরাচরিত নিয়মে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হবে। এরপর সবাই বিষয়টি ভুলে যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নেবে তা কেউ জানতে পারবে না। এটাও কি অপরাধতুল্য অবহেলা নয়? অনেকে বলবেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা। অপরাধতুল্য অপরাধীর বিচার করাই জবাবদিহিতা। এর কোনো বিকল্প নেই। ফ্লাইওভারের ঘটনা এখন অনেকেই বিশ্লেষণ করছেন। দায়ী করা হচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কম্পানিকেও দায়ী করা হচ্ছে।
প্রথমোক্ত বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন- এক. সিডিএর মাস্টারপ্ল্যান লঙ্ঘন করা হয়েছে, দুই. সিডিএ কর্তৃপক্ষ ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা জরিপ (Feasibility) করেনি, তিন. সরকার ব্যয়বহুল প্রকল্প সম্ভাব্য জরিপ ছাড়া অনুমোদন করতে পারে না এবং চার. মাস্টারপ্ল্যানে এসব অবকাঠামোর কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় কারিগরি বিষয়ক যুক্তি। এ-সংক্রান্ত সব ধরনের ত্রুটি হয়তো গঠিত তদন্ত কমিটি চিহ্নিত করবে। এর মধ্যে একটি ব্যয়বহুল অবকাঠামো সম্ভাব্যতা জরিপ ছাড়াই সরকার কেন অর্থের জোগান দিয়েছে সে প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। এটা গুরুতর অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে। কারণ ব্যয়বহুল প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রকল্প ছকেই সম্ভাব্যতা জরিপের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি যুক্ত।
বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের তুলনায় আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্ট কারখানার আগুনের ঘটনাটি সংগত কারণে বহুল প্রচারিত ছিল। মৃত ১১২ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ শ্রমিককে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার বিষয়ে বহুমুখী বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। এরা তিনটি বিষয় তদন্তের জন্য চিহ্নিত করেছে। আগুন লাগার কারণ কি ধ্বংসাত্মক ঘটনা, কুউদ্দেশ্যে নাশকতামূলক ঘটনা নাকি বিদ্যুতের শর্টসার্কিটের ফলে আগুন লেগেছে। কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের কথাও বলেছেন। ঘটনার প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিনে কারখানার কোনো এক মহিলা কর্মী অর্থের বিনিময়ে গোপনে আগুন লাগিয়েছে। জানা যায়, এই মহিলা কর্মীসহ একজন পুরুষকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশি তদন্ত নিশ্চয়ই হবে। জানা যাবে আরো তথ্য। শেষ পর্যন্ত অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হবে কী? যে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে তার কর্ণধার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই ধ্বংসাত্মক (Subversive) কর্মকাণ্ডকেই চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা অতীতেও দৃশ্যমান ছিল। প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগাম কোনো বক্তব্য দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ এর ফলে তদন্ত কমিটি প্রভাবিত হতে পারে। টিভি-মিডিয়ার প্রচারণায় আর একটি বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়াও দুর্ঘটনাকবলিত কারখানা শ্রমিকরা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা কারখানার ওপরের তলায় ছিলেন। আগুনের ধোঁয়া দেখে তাঁরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্মরত সুপারভাইজার তাঁদের এ কথা বলে আশ্বস্ত করে যে তাঁদের বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ কথা সুপারভাইজার সরল বিশ্বাসে বলতে পারেন; কিন্তু পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। তবে সুপারভাইজারের উচিত ছিল বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই এ কথা বলা।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে এর জন্য করণীয় বিষয়েও কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আগুন নেভানোর বিষয়ে কিছু অসুবিধার কথাও বলেছেন। এক. অনেক কারখানাই সরু গলিতে অবস্থিত। আশপাশে পানিরও কোনো সংস্থান নেই। অতীতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কারখানায় রাখার কথা ও শ্রমিকদের এ যন্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ কাজ অনেকেই সম্পন্ন করেননি। ধোঁয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্যাসমাস্কের সংস্থান করার পরামর্শও তাঁরা দিয়েছেন; কিন্তু বেশির ভাগ কারখানার মালিক এতে কর্ণপাত করেননি।
অন্যদিকে অতীতে ফায়ার সার্ভিসের একজন মহাপরিচালকও সংশ্লিষ্ট আইনের উল্লেখ করে আইনের বিধান সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তাঁর দপ্তরের কঠোর নজরদারির কথাও বলেছেন। এ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে তাঁরা ব্যর্থ কেন? এ যুক্তিও প্রাসঙ্গিক। প্রচলিত কারখানা আইনেও শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ সম্পর্কে বিধিবিধান রয়েছে। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়সহ সংস্থাও রয়েছে। তারা কী করেছে? আশুলিয়ার দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতিদিন এ সম্পর্কে সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে ভবিষ্যতে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মতামতও দেওয়া হয়েছে। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কিছু সুপারিশও দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়িত হবে কি?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.