বিদেশি ক্রেতাদের ২১ শর্ত-নতুন অর্ডারে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা by রাশেদুল তুষার

আশুলিয়ায় আগুন ও হতাহতের ঘটনায় দেশের পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গতকালই সিঙ্গাপুরে বৈঠক করে অনেক বিদেশি ক্রেতা (বায়ার) তাঁদের এ দেশীয় কারখানামালিকদের (পণ্য উৎপাদক ও সরবরাহকারী) কাছে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
পাশাপাশি কিছু বিখ্যাত বায়ার সোশ্যাল কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে (অগ্নিনিরাপত্তা) ২১টি কঠোর শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শর্তগুলো পূরণ না হলে নতুন অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন একাধিক পোশাক কারখানার কর্মকর্তা।
এই পরিস্থিতিতে নিট খাতের রপ্তানি মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ গতকাল সদস্যভুক্ত সব কারখানায় জরুরি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। বার্তায় বিদ্যুৎ নিরাপত্তার পাশাপাশি নাশকতা এড়াতে অজানা ও অপরিচিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমপ্লাইয়েন্স (প্রতিপালনীয়) ইস্যুতে বায়াররা নজরদারি বাড়াবেন বলে কারখানামালিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ফলে পোশাক শিল্প মালিকরাও কমপ্লাইয়েন্স ইস্যু বাস্তবায়নে তোড়জোড় শুরু করেছেন।
টার্গেট, ওয়ালমার্ট, এইচঅ্যান্ডএম, ফিয়ারসের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এ দেশীয় বিক্রেতাদের কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে সতর্ক করেছে। বেপজা ও বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, রবিবার বিকেলে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বায়াররা বাংলাদেশের কমপ্লাইয়েন্স (প্রতিপালনীয়) ইস্যু নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে ঢাকার আশুলিয়ায় গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই বৈঠকে কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে নিজেদের কোনো ভুলত্রুটি ছিল কি না, সে বিষয়ে আলোচনা হয়।
বায়ারদের উদ্বেগের কথা স্বীকার করে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে বায়ারদের উদ্বেগের কথা জানানো হচ্ছে। আমি নিজেও কিছু শুনতে পাচ্ছি। হতাহতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবেও ঘটনাটি প্রচার পেয়েছে বেশি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের পাশাপাশি এখন আমাদের বায়ারদের আস্থা ধরে রাখাটাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়াররা এখন কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুগুলোতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়য়ে এখন সরকার ও বিজিএমইএকে পাশাপাশি কাজ করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'শনিবার রাতে আশুলিয়ায় এবং আজ (সোমবার) ঢাকার দক্ষিণখানের কারখানাতে আগুনের ঘটনার লক্ষণ ভালো নয়। এটা কোনো নাশকতা কি না, ভেবে দেখতে হবে। কারণ ডিসেম্বর ঘনিয়ে এলেই এ ধরনের তৎপরতা বাড়ে।'
শনিবারের দুর্ঘটনার পর থেকেই অনেক বায়ার তাঁদের কারখানা মালিকের সঙ্গে কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি বিদেশি মালিকানাধীন পোশাক কারখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'বায়ারদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আশুলিয়ার আগুনে ব্যাপক হতাহতের কারণে তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন। তাঁরা কমপ্লাইয়েন্স নিয়ে নজরদারি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরই মধ্যে তারা ২১টি নির্দেশনাসংবলিত একটি চেকলিস্ট পাঠিয়েছেন। সব শর্তই আগুন সম্পর্কিত। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হলে অর্ডার বাতিল এবং নতুন করে আর কোনো অর্ডার তাঁরা নাও দিতে পারেন।'
আশুলিয়া ট্র্যাজেডির কারণে বায়ারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পোলো রাল্ফ লরেনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ নিয়ামত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কিছু প্রভাব তো পড়বেই। কারণ একসঙ্গে এত প্রাণহানি অনেক বড় একটি বিষয়। বায়াররা নিজেদের স্বার্থেই কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে কিছু ব্যবস্থা নেবেন। তবে আমাদের কম্পানি থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তাঁরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন।'
তবে তাৎক্ষণিক অর্ডার বাতিল না করলেও কমপ্লাইয়েন্স ইস্যুতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে। এ প্রসঙ্গে নিয়ামত আলী বলেন, 'চীন, ভিয়েতনামে যাওয়া এখন খুব সহজ হবে না। কারণ দেশটি এখন ইলেকট্রনিক ও ভারী শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে। তাই বায়াররা হয়তো এখনই এ দেশ ছেড়ে যাবেন না। তবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এখনই এই ইস্যুতে জোর দিতে হবে।'
বিকেএমইএর সতর্কতা
বিকিএমইএ গতকাল সদস্যভুক্ত সব কারখানায় জরুরি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে। এতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর ইলেকট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড, সুইচবোর্ড ও সার্কিট, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি অবিলম্বে পুনঃপরীক্ষা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ও অজানা ব্যক্তিদের ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের ব্যাপারে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া কাজ চলাকালীন কারখানার প্রধান গেটসহ বিকল্প সব গেট খোলা রাখা, কারখানার চলার পথ বাধাহীন রাখার ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানিয়েছে বিকেএমইএ।
২১ শর্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
১. স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে ভবনের প্ল্যান নিতে হবে
২. ফ্লোরের পরিকল্পনা করার সময় অগ্নিনিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে
৩. নিয়মিত ফায়ার লাইসেন্স
৪. যৌথ মালিকানার ভবনে সম্মিলিত অগ্নি মহড়া
৫. ফায়ার অ্যালার্ম কন্ট্রোল প্যানেল রাখা
৬. আলাদা অগ্নিনিরাপত্তা দল
৭. পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামসহ কন্ট্রোল রুম
৮. অগ্নি সনদ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম
৯. রিজার্ভ ট্যাংকে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণ
১০. প্রডাকশন ফ্লোর, সিঁড়িঘর ও টয়লেটে ব্যাটারি ব্যাক-আপসহ লাইটিং
১১. যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিককে অগ্নিনির্বাপণ, জরুরি চিকিৎসা ও উদ্ধার প্রশিক্ষণ সনদ দেওয়া
১২. ছাদের ২৫ শতাংশ খালি রাখা
১৩. ফায়ার এক্সিটঙ্গুইসার পরিচালনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিককে প্রশিক্ষণ
১৪. নিচতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরো সিঁড়িঘর চলাচলের উপযুক্ত রাখা
১৫. অগ্নিনির্বাপণের চিত্রসহ পোস্টার এবং ছবি প্রদর্শন
১৬. ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কিছুদিন পরপর অগ্নিনিরাপত্তা সার্ভে পরিচালনা
১৭. তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন ও ওয়্যারিং পরীক্ষা করা
১৮. পরীক্ষিত প্রকৌশলীর মাধ্যমে বিদ্যুৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

No comments

Powered by Blogger.