্উপমহাদেশ-প্রেরণা জোগাবে ক্রিকেট কূটনীতি by এম আবদুল হাফিজ

াদু'দেশেরই প্রধানমন্ত্রীরা কখন কীভাবে চূড়ান্ত আলোচনায় বসবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ক্রিকেট কূটনীতিরই ওপর। গতানুগতিক কূটনীতি যা এক যুগেও পারেনি; শান্তিকামীদের প্রত্যাশা, ক্রিকেট কূটনীতির প্রটোকলমুক্ত আন্তরিক পরিবেশে তার সুরাহা করতে পারবে
ঔপনিবেশিক আমলের কুখ্যাত 'গানবোট ডিপ্লোম্যাসি'র বিপরীতে অধুনা আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে ইতিবাচক ও মহৎ যেসব উদ্ভাবন ঘটেছে তার অন্যতম এই ক্রিকেট কূটনীতি, যাতে পূর্বোক্ত কূটনীতির অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই, নেই কোনো বলপ্রয়োগ। দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ এই উপমহাদেশে এর আগে আমরা ট্র্যাক-টুসহ একাধিক কূটনীতির কথা শুনলেও এখনও অন্তত ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নিরসনে ক্রিকেট কূটনীতিই স্থান করে নিয়েছে।
মোহালিতে উভয় দেশের নির্বাহী প্রধানদের একত্রে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল উপভোগ এমন কূটনীতির সর্বশেষ মহড়া হলেও এর সূচনা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, যখন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট দেখার ছুতোয় জয়পুরে যান। কিন্তু তার ক্রিকেট উপভোগের অন্তরালে ছিল সে সময়কার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উত্তাপকে প্রশমন করা এবং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে একটা চূড়ান্ত বোঝাপড়ার সূচনা করা। বলাবাহুল্য, ১৯৮৭ সালে জিয়াউল হকের সে উদ্দেশ্য অনেকটাই পূর্ণ হয়েছিল।
একই কূটনীতির ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও ২০০৫ সালে ক্রিকেট দেখার বাহানায় ভারতে গেলে একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভারত সরকারের যথাযথ প্রটোকল পান। দিলি্লতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ রীতিমতো একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তিনি এক বিরল রসায়ন (ঈযবসরংঃৎু) সৃষ্টিতে সক্ষম হন এবং ভারতের এই বর্ষীয়ান নেতার সঙ্গে আলোচনায় কাশ্মীর প্রসঙ্গও উঠে আসে, যদিও ইতিপূর্বে পাকিস্তান এই প্রধান ইস্যুটিকে আগের সব আলোচনায় পাশ কাটিয়ে গিয়েছে।
সঙ্গত কারণেই অতীতে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এমন কূটনীতিচর্চায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। ওইসব আলোচনার পরও সামরিক বনাম বেসামরিক সমীকরণ প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্টদের বেগ পেতে হতো। মোহালিতে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ গিলানিকে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি। অন্তত ক্রিকেট কূটনীতিতে গিলানিই আলোচনায় প্রথম সমকক্ষ ছিলেন, যার গণতান্ত্রিক ক্রেডেনশিয়াল ছিল।
উভয় দেশের শান্তিকামীদের এখন প্রত্যাশা, মোহালির এই কূটনীতি অদূর ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য সেক্রেটারি পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে অর্থবহ করতে প্রেরণা জোগাবে।
২০০৮-এ মিসরের শারম-এল-শেখে এবং ২০০৯-এ ভুটানের থিম্পুতে উভয় দেশের নেতৃত্ব তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও এতদিন শান্তি আলোচনা স্থবিরাবস্থায় ছিল। মোহালির তাগাদায় তা সক্রিয় হবে কি-না সেটাও এখন দেখার বিষয়। যদি তা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, ক্রিকেট কূটনীতি শেষ পর্যন্ত গতানুগতিক কূটনীতির স্থান নিয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কোন্নয়নের বাইরেও পাকিস্তান তার পশ্চিম ফ্রন্টেও সম্প্রতি এক সমমর্যাদার অবস্থানে পেঁৗছতে চেষ্টা করছে_ বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯ সালে আফ-পাক স্ট্র্যাটেজির ঘোষণা দেওয়ার পর। এই ঘোষণায় পাকিস্তানকে ভারত থেকে বিযুক্ত করে আফগানিস্তানকে যুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এতে করে ওবামা পাকিস্তানের মানহানি করেছেন, যা পাকিস্তানের আঞ্চলিক গুরুত্বকে খর্ব করেছে এবং ক্ষমতার আঞ্চলিক ভারসাম্য পাকিস্তানের প্রতিকূলে প্রদর্শিত হয়েছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে এক পারমাণবিক জ্বালানি চুক্তি করেছে, যার বিপরীতে ২০০৯ সালের কেরি-লুগার অ্যাক্টের অধীনে পাকিস্তানকে শুধু তারবেলা বাঁধের নতুনত্বের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। পাকিস্তান মনে করে, দেশটি এখনও আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি।
উপরন্তু দু'দেশের মধ্যে শুধু শান্তি সংরক্ষণই উভয় দেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে দু'দেশের মধ্যে জনগণের পর্যায়ে একটি সংযোগ, যা শুরুও হয়েছিল ২০০৮ সালের মুম্বাই ট্র্যাজেডির পর, তা-ও থেমে যায়। যদিও পাকিস্তান বিরাষ্ট্রীয় সত্তাগুলোকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের কোনো ক্ষতিসাধন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। ভারত এ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। ভারতীয়দের ধারণায়, যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে সন্ত্রাস করে তারা সামরিক বাহিনী ও আইএসআইর নিয়ন্ত্রণে। বেসামরিক কর্তৃপক্ষ এদের নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম।
পাকিস্তান তার পশ্চিম সীমান্তেও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী অব্যাহতভাবে তাদের ড্রোন হামলার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত লঙ্ঘন করে চলেছে, যাতে নিরীহ বেসামরিক পাকিস্তানিদের প্রাণহানি ঘটছে। পূর্ব সীমান্তে ভারত এখনও মনে করে, মুম্বাইসদৃশ সন্ত্রাস আবার ঘটতে পারে। এ ধরনের নতুন কোনো এপিসোড ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্য সার্বক্ষণিক উদ্বেগের বিষয়। পারস্পরিক অবিশ্বাসও চরমে। আগামী আলোচনায় আলোচ্য ইস্যুর মধ্যে ভারত ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের কাছে মুম্বাই হামলার পরিকল্পকদের হস্তান্তর দাবি করেছে। আসলে মুম্বাই হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ঘটনার উন্মোচন দু'দেশের শান্তি আলোচনার পূর্বশর্ত করে রেখেছে ভারত। ওই আলোচনায় কাশ্মীর আদৌ স্থান পাবে কি-না সেটা আরও পরের বিষয়।
তবে দু'দেশেরই প্রধানমন্ত্রীরা কখন কীভাবে চূড়ান্ত আলোচনায় বসবেন, তা অনেকটাই নির্ভর করছে ক্রিকেট কূটনীতিরই ওপর। গতানুগতিক কূটনীতি যা এক যুগেও পারেনি; শান্তিকামীদের প্রত্যাশা, ক্রিকেট কূটনীতির প্রটোকলমুক্ত আন্তরিক পরিবেশে তার সুরাহা করতে পারবে। কেননা মাত্র কিছু হুল ফোটানো বিষয় বাদ দিলে দু'দেশের জনগণের মধ্যে ভালোবাসা প্রগাঢ়। তাদের রুচি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা-সংস্কৃতিতেও পার্থক্য সামান্য। এদের বল্পুব্দত্ব অবশ্যম্ভাবী এবং তা শুধু সময়ের ব্যাপার।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.