দাম নেই শুধু শ্রমিকের জীবনের by আবুল কাশেম

কারখানায় আগুন লেগে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেই তড়িঘড়ি করে গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের এক লাখ টাকা 'ক্ষতিপূরণ' দেওয়ার ঘোষণা দেন মালিকরা। গত শনিবার রাতে আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লেগে ১১০ জন শ্রমিক মারা যাওয়ার পরও তাই-ই হলো।
রবিবার সকালে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। বিভিন্ন গার্মেন্টে ২০০০ সাল থেকে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন প্রায় ৬০০ শ্রমিক। অবশ্য বিজিএমইএর হিসাবে এ সংখ্যা মাত্র ২৭৫ জন। এ হিসাব ধরলে আগুনে প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ বাবদ বিজিএমইএর এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে মাত্র দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ বছরে গার্মেন্ট খাতের রপ্তানি আয় এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর দেশের অর্থনীতিতে এই বিপুল অবদানের কৃতিত্বের বড় অংশীদার যে শ্রমিকরা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সর্বশেষ আশুলিয়ায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বিজিএমইএর যে খরচ হবে, তা তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের দুই দিনের রপ্তানি আয়ের সমান। গত বছর তিনি রপ্তানি করেছেন প্রায় চার কোটি ডলারের পোশাক।
গত তিন দশকে যথেষ্ট উৎপাদন দক্ষতা অর্জন করেছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। এখনো সস্তা শ্রমই এ শিল্পের বিকাশের মূল শক্তি। এর বদৌলতেই বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখতে পারছে প্রায় পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর এ রপ্তানি খাত। কম দামে পোশাক কেনার উৎস হিসেবে বিশ্বের বড় বড় পোশাক ব্র্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ আকর্ষণীয়। পোশাক বানাতে যা কিছু লাগে, তার সবই রয়েছে চীনে। সস্তায় পণ্য তৈরিতেও দেশটি সিদ্ধহস্ত। সেই চীনও এখন ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। কারণ তাদের শ্রমের মূল্য যে হারে বেড়েছে, তাতে খরচ পোষায় না। বাংলাদেশেও শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। এর পরও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পোশাক বিক্রি করত সক্ষম এ দেশের শিল্পমালিকরা। এ সক্ষমতায় তাঁদের যতখানি কৃতিত্ব, তার চেয়ে অনেক বেশি ত্যাগ শ্রমিকের। পোশাকের বিশাল রপ্তানি ও তার পেছনে বিপুল আমদানি বাণিজ্যে মওকুফ করা শুল্ক টাকার অঙ্কে কত দাঁড়ায়, তার হিসাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ড জানে। গবেষকদের হিসাবে, ১০০ ডলার রপ্তানি আয়ের পেছনে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি আমদানি বাবদ ব্যয় হয়ে যায় ৮০ ডলার। ২০ ডলারের সমপরিমাণ স্থানীয় মূল্য সংযোজন, খুচরা কিছু উপাদান বাদ দিলে তা আসে শ্রমিকের কায়িক শ্রম থেকে। তবু পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শিল্পশ্রম নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। তাঁদের জীবনের দাম যে কতটুকু ধরা হয়, বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তা স্পষ্ট বলে দেয়।
'আমরা বারবার আপনাদের অগ্নির জ্বালানি হতে চাই না,' মালিকদের উদ্দেশে কথাগুলো বললেন গার্মেন্ট শ্রমিক অধিকার নেত্রী নাজমা আক্তার। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে শনিবার রাতে ঘটে যাওয়া দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি বলেন, 'এ দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকরাই সবচেয়ে সস্তা। তাঁদের জীবনের কোনো দাম নেই মালিকদের কাছে।' এ নেত্রী বলেন, একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই গণমাধ্যমসহ সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে, এরপর সবাই ভুলে যায়। মিড-লেভেল ম্যানেজমেন্টকে দোষ দেওয়া হচ্ছে, এটাতো মালিকদেরই দেখতে হবে। দায় এড়ানোর চেষ্টা না করে সরকার ও মালিকদের অগ্নি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের শ্রদ্ধাবোধ থাকলেই অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তাঁর বিশ্বাস।
তাজরীন পোশাক কারখানায় ১১১ জন পোশাক শ্রমিকের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় রপ্তানি খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। গতকাল সংস্থাটির কার্যালয়ে আঙ্কটাডের এক প্রতিবেদন প্রকাশকালে এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। সিপিডির 'সম্মানিত ফেলো' ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে পোশাক খাত অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু শনিবার তাজরীন ফ্যাশনসে পোশাককর্মীদের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা এ খাতকে এক ধাক্কা দিয়ে অনেক পেছনে নিয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, সারা বিশ্বে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়টি নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা নিয়েও অনেক আলোচনা হচ্ছে। এ দুর্ঘটনার ফলে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'অতীতে পোশাক খাতে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার একটিরও সঠিক তদন্ত হয়নি। কিন্তু গত শনিবারের দুর্ঘটনা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। আমরা জেনেছি ইতিমধ্যে কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি যাতে কোনো ধরনের শৈথিল্য না দেখায়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ দুর্ঘটনায় গতানুগতিক প্রতিবেদন দেওয়া হলে পোশাক খাতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে।
গার্মেন্ট মালিকদের কাছে শ্রমিকের ভালোমন্দ বিবেচনার চেয়ে মুনাফার চিন্তাই প্রধান। তাঁরা দেখেন কত কম খরচে কত বেশি লাভ করা যায়। বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বলেন, 'একবার এক কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পাই, বাথরুমের ভেতরেও একটি মেশিন বসানো হয়েছে। এটা শুরুর দিককার ঘটনা। এখন মালিকরা বাসাবাড়ি থেকে কারখানা সরিয়ে ঢাকার বাইরে নিলেও জমির উচ্চমূল্যের কারণে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা বা শ্রমিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।'
অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে বিজিএমইএর তৎপরতা কিছু মনিটরিং সেল গঠন আর অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার মধ্যেই সীমিত। আগুন থেকে শ্রমিকের প্রাণ রক্ষায় পর্যাপ্ত বিকল্প সিঁড়িসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণের অভাব রেখে বিজিএমইএ কেবল শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয়। ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিজিএমইএ মাত্র এক হাজার ৮৮৮টি কারখানার ৪৪ হাজার ৪৫৫ শ্রমিককে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অথচ বিজিএমইএর সদস্যদের চার হাজারেরও বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখের মতো।
বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে গ্রুপ ইনস্যুরেন্স থেকে যে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়, তা ওই পরিবারের তেমন কোনো কাজে আসে না। তাই বিকেএমইএ থেকে ইনস্যুরেন্সের পরিমাণ বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করার একটি প্রস্তাব জীবন বীমা করপোরেশনে পাঠিয়েছেন তাঁরা।
২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার কারখানায় আগুন লাগলে কারখানার মূল গেটসহ ভেতরের সব গেটও বন্ধ করে রাখে মালিকপক্ষ। ফলে বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রাণ হারাতে হয় ২১ জন শ্রমিককে। বিজিএমইএ ওই শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা ও মালিকপক্ষ এক লাখ করে মোট দুই লাখ টাকা দিয়েছে।
কোনো কোনো মালিক আবার নিহত শ্রমিক পরিবারগুলোকে বাড়তি অর্থও দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন হা-মীম গ্রুপের মালিক ও এফবিসিসিআইয়ের বিদায়ী সভাপতি এ কে আজাদ। গত বছর তাঁর কারখানায় আগুনে নিহত হওয়া ২১ জন শ্রমিকের প্রতি পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছেন তিনি। তবে এ ধরনের উদাহরণ কম।
হা-মীমের কারখানায় আগুন লাগার পর কারখানাটিতে কোনো পানি না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত আগুন নেভাতে পারেননি। তাজরীন ফ্যাশনসেও পানির ব্যবস্থা ছিল না। ঢোকার রাস্তা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচলের উপযোগী নয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, ফায়ার অ্যালার্ম বাজলেও তাঁদের বলা হয়েছে, তেমন কিছু হয়নি। একটি মাত্র ফটক, সেটিও বন্ধ ছিল। আগুন নেভানোর যেসব যন্ত্রপাতি ছিল, সেগুলোর ব্যবহার হয়নি।
শ্রমিক মৃত্যুর কোনো দায় নিতে রাজি নন মালিকরা। ফটক বন্ধ রাখা বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কাজে না লাগানোর জন্য বিজিএমইএর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এখন দায় চাপাচ্ছেন মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্মচারীদের ওপর। বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মালিকরা কারখানায় বসে থাকেন না। তাঁদের আরো দশ ধরনের কাজ করতে হয়। গেট বন্ধ-খোলার ব্যাপারগুলো মধ্যম সারির কর্মকর্তারা দেখেন। তাই কোনো কারণে গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিক মারা গেলে এর দায় সরাসরি মালিকের ওপর বর্তায় না।
তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক-ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন অন্য কথা। গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, গেট বন্ধ ছিল- আগুন লাগার পর এটা শ্রমিকদের একটা সাধারণ অভিযোগ। কোনো গেটই বন্ধ ছিল না। শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল।
তাহলে এত শ্রমিক মারা যাওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে দেলোয়ার বলেন, 'কিছু নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা হয়তো কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তাই মারা গেছে।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই দিন আগে ওই গার্মেন্টে কর্মীদের আগুনের ওপর নামমাত্র একটি মহড়া দেওয়া হয়। সেটা নিয়েও শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

No comments

Powered by Blogger.