চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার দুর্ঘটনা-নির্মাণ ত্রুটি উপেক্ষার করুণ পরিণতি

গত ২৯ জুন চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের একটি গার্ডার ভেঙে পড়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ দুর্ঘটনার দায় সম্পূর্ণরূপে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নির্মাণ শ্রমিকদের ওপর।
বলা হয়েছিল, ডিজাইনে কোনো ত্রুটি ছিল না এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যথাযথ নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার করেছিল। তখনই সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছিল যে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার জন্যই এ দায়সারা প্রতিবেদন। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস পর ২৪ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় একই ফ্লাইওভারের বিশালাকৃতির তিনটি গার্ডার যখন ভেঙে পড়ে, তখন দেখা যায় ৮০ টন ওজনের একেকটি গার্ডারের কিছু কিছু অংশ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। এতে এটা স্পষ্ট যে নির্মাণকাজে রড, বালু ও সিমেন্টের সংমিশ্রণ যথাযথ মাত্রায় ছিল না। রোববার একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে একজন প্রকৌশলীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, 'দুটি পিলারের সংযোগ সৃষ্টিকারী গার্ডারগুলোর মধ্যে ক্রস গার্ডার দিতে হয়। ক্রস গার্ডারের কাজ শেষ করার আগে ওজন ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার ছিল। এটির তা ছিল না বলে মনে হচ্ছে।' ২৯ জুনের দুর্ঘটনার কারণে ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ ব্যাহত হয়; কিন্তু কারও মৃত্যু হয়নি নিচের সড়কে মানুষ বা যানবাহন না থাকায়। এর প্রায় পাঁচ মাস পর একই ফ্লাইওভারে আরও বড় মাত্রার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৬ জনের। ভেঙে পড়া গার্ডারগুলোর একেকটির ওজন প্রায় ৮০ টন করে। বহদ্দারহাট চট্টগ্রামের অন্যতম প্রবেশমুখ। চট্টগ্রামের ৭টি উপজেলাসহ বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সব গাড়ি এ পথ দিয়েই বন্দরনগরীতে ঢোকে ও বের হয়। ফ্লাইওভারটি এক বা দুই মাসের মধ্যেই চালু হওয়ার কথা। এ কারণে কাজ চলছিল জোরেশোরে। নিম্নমানের কাজের কারণে সেতুটি চালু হওয়ার পর যদি ধসে পড়ত, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় দারুণ বিঘ্ন ঘটত। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও ছিল অনেক বেশি। জুন মাসের দুর্ঘটনার পর যদি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নির্মাণকাজের ত্রুটি সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে নিত এবং ডিজাইন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করত, তাহলে হয়তো ২৪ নভেম্বর ১৬ জনের প্রাণহানির মতো বিপর্যয় ঘটত না। সর্বশেষ দুর্ঘটনার ব্যাপকতার পর ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১.৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের ফ্লাইওভারটির ডিজাইন ও কাজের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠবেই। সময়মতো কাজ শেষ হবে, এ আশা এখন আর কেউ করবে না। বরং কোনো কোনো মহল থেকে 'স্থায়ী মৃত্যুফাঁদে' পরিণত হওয়ার আগেই এ প্রকল্প বাতিল করার দাবি উঠবে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার খেসারত কে দেবে? ফ্লাইওভারটির কাজের ঠিকাদারি পেয়েছিল একটি প্রতিষ্ঠান। শনিবারের দুর্ঘটনাস্থলে কাজ করছিল আরেকটি সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। খেয়াল রাখতে হবে যে, তাদের পারস্পরিক দোষারোপে যেন মূল বিষয় চাপা না পড়ে। প্রকৃত দোষীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা চাই। এ কাজে যেন সংশ্লিষ্টরা গাফিলতি করতে বা দায় এড়াতে না পারে, সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.