ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে ওষুধ কম্পানিগুলোর অমানবিক প্রতারণা by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ

১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে গুয়াতেমালায় ঘটে গেল চিকিৎসাবিজ্ঞানের কলঙ্কময় একটি ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অমানবিক ও অনৈতিক হলেও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তা অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা।
ইউনাইটেড স্টেটস পাবলিক হেলথ সার্ভিসের চিকিৎসক জন চার্লস কাটলার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে গুয়াতেমালায় ১৯২৮ সালে আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন নিয়ে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (নতুন উদ্ভাবিত ওষুধের কার্যকারিতা, নিরাপত্তা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বিষক্রিয়া নির্ণয়ের জন্য জীবজন্তু ও মানুষের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা) চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য গুয়াতেমালার দেড় হাজার কয়েদি, সেনা সদস্য, মানসিক রোগী ও পতিতাকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নির্বাচন করা হয়। অত্যন্ত গোপনে এসব মানুষের শরীরে জীবাণু ঢুকিয়ে সিফিলিস ও গনোরিয়া যৌন সংক্রামক রোগ উৎপন্ন করা হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী কেউ এসব অপকর্মের কথা জানত না। টাকার বিনিময়ে পতিতাদের গনোরিয়া ও সিফিলিসে আক্রান্ত কয়েদিদের সঙ্গে যৌনমিলনে রাজি করানো হয়। এতে পতিতারাও সিফিলিস ও গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সিফিলিস রোগ প্রতিকার বা প্রতিরোধে পেনিসিলিন কত কার্যকর, তা নির্ণয়ের জন্য এসব রোগীকে পেনিসিলিন প্রদানপূর্বক পরীক্ষা চালানো হয়। এই পরীক্ষা চলাকালে ৮৩ জন রোগী মৃত্যুবরণ করে। ১৯৪৮ সালে অসমাপ্ত রেখেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পেনিসিলিন-স্বল্পতা ও অত্যধিক দামের কারণে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট এসব বিপজ্জনক রোগে পর্যাপ্ত পেনিসিলিন প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। এ কারণে অনেক রোগী রোগাক্রান্ত থেকে যায় বা মৃত্যুবরণ করে। ২০০৫ সালে ওয়েলেসলি কলেজের অধ্যাপক সুজান মকোটফ রেবারবি কার্টলারের আর্কাইভে গবেষণার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে এই অনৈতিক ও অমানবিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা জানতে পারেন। পরে তিনি এ ঘটনার কথা আমেরিকান কর্মকর্তাদের নজরে আনেন। রেবারবি কাটলারের গবেষণার কাগজপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ করেন, কাটলার এক জায়গায় লিখেছেন, এক মহিলা মানসিক রোগীকে সিফিলিসে আক্রান্ত করার পর তিনি প্রায় মারা যাচ্ছিলেন। তার পরও কাটলার তাকে পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেননি, তাকে নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে যান। তাকে আবারও যৌন সংক্রামক রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীটি অত্যন্ত কঠিন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মারা যায়। রয়টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. রেবারবি ঘটনাটি ফাঁস করে দেওয়ার পর ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট আলবেরো কলোম ও সে দেশের জনগণের কাছে এই অমানবিক ও নৃশংস ট্রায়ালের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এ বছরের ২৬ মে ল্যানসেট জার্নালে ভারতে পরিচালিত এক অনৈতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালে বহুজাতিক ওষুধ কম্পানি কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ভারতে প্রায় এক হাজার ৬০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। শুধু প্রাপ্তবয়স্কই নয়, আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত এসব ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৪৯টি শিশুও মৃত্যুবরণ করে।
চলতি বছরের ২৮ আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ভাষ্যমতে, নাইজেরিয়ার ৩০টি পরিবার ফাইজার কম্পানির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, ১৯৯৬ সালে নাইজেরিয়ার শিশুদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিক ট্রোভানের (ট্রোভাফ্লক্সাসিন) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়। নাইজেরিয়ায় মেনিনজাইটিস মহামারিতে ১৯৯৬ সালে ফাইজার ১০০টি শিশুর ওপর ট্রোভানের কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা চালায়। এই পরীক্ষায় ১১টি শিশু মারা যায়। অনেকের মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, অনেকেই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও বধির হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সূত্রমতে, শুধু ১৯৭৮ সালে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫ লাখ রোগী সুস্থ হওয়ার জন্য ওষুধ খেয়ে মৃত্যুবরণ করে। সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০ শতাংশ রোগী ওষুধ খেয়ে আরো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ওষুধের কারণে এক লাখ ৮০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর কারণ প্রেসক্রিপশন ড্রাগ বলে জানা যায়। ওপরে উল্লিখিত মৃত্যুর সংখ্যা বাদ দিয়েও বলা যায়, ওষুধের কারণে এমন লাখ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা মৃত্যুবরণ করছে, যার কোনো হিসাব রাখা হয় না। ১৯৬১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত নিরাপদ হিসেবে আখ্যায়িত করে সারা বিশ্বে দুই লাখ পাঁচ হাজারের বেশি ওষুধ বাজারজাত করা হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়া হয় এবং ১২ হাজার আবার বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৩ সালে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ ৯১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়। চিকিৎসাসেবার ধরন, মান ও টাকার অঙ্ক হিসাব করলে যে কারো ধারণা হতে পারে যে আমেরিকানরা বিশ্বের সবচেয়ে সুস্থ জাতি। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। মহিলাদের আয়ুষ্কালের দিক থেকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ১৬ ও পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৭। শিশুমৃত্যুর দিক থেকে এ দেশটির অবস্থান আরো নিচে, স্থান ২১।
ওষুধের কারণে কেন মানুষ এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত্যুবরণ করছে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড ভাবনা-চিন্তায় পড়েছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ওষুধের কারণে মৃত্যু বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে কাজ করছে চিকিৎসক ও রোগী কর্তৃক ভুল ওষুধ প্রয়োগ বা গ্রহণ। প্রশ্ন আসে, এসব ক্ষতিকর ওষুধ কিভাবে বাজারে চলে আসে বা বাজারে আসার অনুমতি লাভ করে?
অনেক ক্ষেত্রেই মানবদেহে সৃষ্টরোগ জীবদেহে তৈরি বা নকল করা একেবারেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কথাই ধরা যাক। একে বাংলাতে বলা হয় গেঁটে বাত। এটি একটি ক্ষয়কারক রোগ, যা জয়েন্ট বা গিঁটে হাড়ের ক্ষয় বা বিকৃতির কারণে স্থানচ্যুত হয় বলে নড়াচড়ার সময় প্রচণ্ড ব্যথা হয়। গবেষণার সময় এই রোগটি অবিকল নকল বা সৃষ্টি করে ওষুধের পরীক্ষা চালানো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস মানবদেহে প্রাকৃতিক নিয়মেই উৎপন্ন হয়। ওষুধের পরীক্ষা চালানোর জন্য অবিকল এ রকম একটি রোগ সৃষ্টি করার জন্য জীবদেহে নানা রকম অসংগতিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে হয়।
শিশুদের শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে না এবং তাদের শরীরে বিভিন্ন সিস্টেম ও মেটাবলিক প্রক্রিয়া পরিপূর্ণতা লাভ করে না বলে তাদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো বিপজ্জনক। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। পরীক্ষার নমুনা ওষুধটি যথেষ্ট নিরাপদ না হলে তা গর্ভবতী মহিলাদের প্রয়োগ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালালে মা ও গর্ভজাত সন্তানের প্রভূত ক্ষতি হতে পারে। তাই শিশু, মহিলা বা বয়স্কদের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা প্রায়ই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁরা নিজেদের দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে সরলতা, অজ্ঞতা ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে কিছু আর্থিক সুবিধা দিয়ে অনুন্নত ও গরিব দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষ নির্বাচন করে নতুন ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে মানবদেহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রচুর সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এ কারণে প্রতিটি ধাপে রয়েছে মনিপিউলেশন ও দুর্নীতির সুযোগ। অসাধু গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের যোগসাজশে ওষুধ কম্পানিগুলো সময় ও অর্থ বাঁচানোর জন্য অপর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ কম্পানিগুলোর ভাড়া করা গবেষকরা মানবদেহে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন না করেই শুধু জীবজন্তুর ওপর কিছু পরীক্ষা চালিয়ে ওষুধ বাজারজাত করে থাকেন। এর ফলে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে অপরিসীম।
ওষুধ উদ্ভাবনে জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ এসব জীবজন্তুর ওপর পরীক্ষার ফলাফল মানুষের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যক্রমে জীবজন্তু বা মানবদেহে ওষুধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা-সংক্রান্ত তথ্যাবলি বা ডাটা গোপন রাখা হয় বলে জনগণ এ ব্যাপারে কিছুই জানতে পারে না। অতি অল্পসংখ্যক জীবজন্তু ও মানুষের ওপর কোনো ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয় বলে অনেক সময় এসব ওষুধের কার্যকারিতা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় না। বাজারজাত হওয়ার পর লাখো-কোটি মানুষ এসব ভুল ওষুধ গ্রহণ করে বলে প্রকৃত কার্যকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় না। মার্ক কম্পানির ভায়োক্সের ট্রায়ালে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে বলে কম্পানি কোনো সময় স্বীকার করেনি। অথচ ২০০০ সালে বাজারজাত হওয়ার পর থেকে পরবর্তী চার বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ এই ওষুধ গ্রহণ করে হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মৃত্যুবরণ করে।
পৃথিবীর বহুজাতিক ওষুধ কম্পানিগুলো চায় না যে আমরা ওষুধ সম্পর্কে সত্য কথাগুলো জেনে ফেলি। তারা এ-ও চায় না, ওষুধের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে আমরা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করি বা উৎসুক্য প্রকাশ করি, যদিও এসব ওষুধের ওপর আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করে। তবে আমাদের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ যে নেই, তা নয়। ওষুধ কম্পানিগুলো মনে করে ও স্বীকার করে, যখনই আমরা কোনো ওষুধ গ্রহণ করি বা খাদ্য ও পরিবেশ থেকে আবির্ভূত কোনো রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসি, তখন আমরা হয়ে যাই তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সত্যিকার গিনিপিগ।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাবি ও প্রো-ভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.